জি এ এম আশেক উল্লাহ, আনজুমানপাড়া সীমান্ত থেকে: মায়ের বুকের পরম মমতার উষ্ণতা নেই, নেই চিরচেনা আবাসস্থলও। বাবার কোলও নেই। মা বাবা হারানো আট মাস বয়সের শিশুটিকে নিয়ে দাদী তৈয়বা বেগম শিশুটির কান্না থামাতেই পারছিলেন না। নেই কোনো শিশুখাদ্য। উখিয়া উপজেলার বালুখালী এলাকায় একটি পলিথিনের নিচে আশ্রয় হয়েছে তৈয়বা বেগমের। কিন্তু সীমাহীন কষ্টে আছেন তিনি।
মংডুর ভাদনাপাড়া থেকে প্রতিবেশীর সাথে টেকনাফের সাবরাং সীমান্ত দিয়ে দুই ছেলে নিয়ে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন।
তিনি জানান, তার মেয়ের জামাই মোহাম্মদ আলমকে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনারা। পরে তার মেয়ে রেহেনাকে নির্যাতনের পর কেটে ফেলে। চোখের সামনে এসব ঘটনার পর তারা পাহাড়ে লুকিয়ে ছিলেন পাঁচদিন। পরে রেহেনার শিশু কন্যা ফাতেমাকে নিয়ে চলে আসেন সীমান্তে। অন্যদের জন্য কিছু খাবার পাওয়া গেলেও শিশুটিকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন তৈয়বা। শিশুটির কোনো খাবার নেই। সর্দির সাথে জ্বরও এসেছে তার। শুধুই কাঁদছে এতিম এ শিশুটি।
শুধু এ শিশুটিই নয়, এরকম এতিম হয়েছে শত শত শিশু। আশ্রয় পাওয়া এলাকাগুলোতে এসব শিশুর কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে গেছে। উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রিত এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে এরকম চিত্র। ঠিকমত খাবার না পাওয়ায় অপুষ্টিতে ভুগছে শত শত শিশু। একই সাথে রোদ বৃষ্টিতে ভিজে আক্রান্ত হয়েছে সর্দি কাশি ও নিমোনিয়ায়।
শিশুদের সাথে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন রোহিঙ্গা নারীরাও। বিশেষ করে সদ্য প্রসূতি মায়েরা এবং গর্ভবতী নারীদের যে স্বাস্থ্য পরিচর্যা দরকার তার সামান্যটুকুও এখানে নেই। এভাবে মানবেতর জীবন কাটছে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুতুপালংয়ে কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিক, এমএসএফ স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও সীমান্তবিহীন চিকিৎসক দলসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দু’একটি ভ্রাম্যমাণ দলের চিকিৎসা ব্যবস্থা চোখে পড়ে। তবে তা প্রয়োজনের তুলানায় অপ্রতুল। পর্যাপ্ত ঔষধপত্রেরও অভাব। তবুও এসব চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে ভিড় সামলাতে পারছেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা। প্রতিদিন নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসা ব্যবস্থার এখনও অগ্রগতি হয়নি। প্রতিদিন দলে দলে নতুন করে রোহিঙ্গার আগমনের ফলে ভিড় বেড়েই চলেছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গার আগমনের ফলে উখিয়া টেকনাফের এলাকাগুলোর চিত্র প্রতিদিনই বদলে যাচ্ছে। প্রয়োজনের তুলানায় ত্রাণ এখনও অপ্রতুল। ত্রাণের গাড়ি দেখলেই দৌঁড়ে যাচ্ছেন ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গারা।
অনাহারে অর্ধাহারে থাকা রোহিঙ্গা শিশু শহীদ হোসাইন (১০) ত্রাণবাহী গাড়ি দেখে ছুটে যায় তার পেছনে। ত্রাণবাহী গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলা খাবারের প্যাকেট কুড়াতে গিয়ে শহীদ হোসইনকে একটি সিএনজি অটোরিক্সা ধাক্কা দেয়। গুরুতর আহত শিশুটি এখন সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বালুখালী এলাকায় সড়কে এভাবে ত্রাণ নিতে গিয়ে আরেক রোহিঙ্গা শিশু শফিকুর রহমান (১২) অন্য একটি গাড়ির নিচে চাপা পড়ে। শফিকের ডান পা ভেঙে গেছে। ত্রাণের পেছনে হুড়োহুড়ি করে ছুটতে গিয়ে এভাবে প্রতিদিনই আহত হয়ে শিশুরা আসছে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে। শৃঙ্খলা না থাকায় ত্রাণ দিতে আসা অনেক লোকজনও ত্রাণ দিচ্ছেন অপরিকল্পিতভাবে।
এদিকে রোহিঙ্গা রোগির চাপ বেশি হওয়ায় আলাদা একটি ওয়ার্ড খোলা হয়েছে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে। প্রতিদিন দুর্ঘটনা ছাড়াও নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিতে আসছেন জেলা সদর হাসপাতালে। একসাথে বেশি সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। কোনো রোহিঙ্গার অবস্থার অবনতি হলে চট্টগ্রাম মেডিক্যালেও পাঠানো হচ্ছে। কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে এসব রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি সামাল দিতে সদর হাসপাতালে খোলা হয়েছে রোহিঙ্গা সার্জারি ইউনিট।
হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. পুচ নু বলেন, নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে আগুন, গুলি, দা, বোমার আঘাতে আহত। এছাড়া পালিয়ে আসা অধিকাংশই ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত।
চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোহিঙ্গা নারী মরিয়ম, শাহেনা আক্তার, ফরিদা বেগম ও আব্দুল জব্বারসহ অনেকে জানান, রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের পর অনেকে আহতবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিলেও সেখানে খাদ্য, পানি, বাসস্থান ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। কক্সবাজার সদর হাসপাতালের নার্স ইনচার্জ দৌলতুন্নেছা জানান, প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।-নয়াদিগন্ত
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস