আবু সালেহ আকন ও গোলাম আজম খান লম্বাবিল সীমান্ত থেকে : আরো সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে দেড় লাখ নাফ নদীর ওপারে এসে জড়ো হয়েছেন। আরো দুই লাখ বুচিডং ও রাসিডং থেকে বাংলাদেশ সীমান্তের পথে রয়েছেন। নাফ নদীর তীরে যে দেড় লাখ এসেছেন তারা আজ-কালের মধ্যে এপারে আসতে শুরু করবেন।
বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন এমন কয়েকজন রোহিঙ্গা বলেছেন, জড়ো হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে তাদের আত্মীয়-স্বজনও রয়েছেন। তারা বলেছেন, বর্মি বাহিনী ও উগ্রপন্থী মগরা একত্রে অনেক রোহিঙ্গা দেখলে তাদের ওপর আক্রমণ করে না। বিচ্ছিন্নভাবে কাউকে পেলে তার আর রক্ষা নেই। যে কারণে রোহিঙ্গারা এখন দলে দলে আসেন। তাদেরকে দেখলে বর্মি সেনারা বলে ‘তোয়া’। যার অর্থ ভেগে যা।
এ দিকে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো ঘুরে গতকাল দেখা গেছে, এখনো ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে প্রশাসন কোনো নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। যে যার ইচ্ছেমতো ত্রাণ দিচ্ছে। খাবার ও নগদ অর্থের জন্য হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রাত-দিন কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের পাশে অবস্থান করছেন। গাড়ি দেখলেই তারা দৌড়ে আসছেন ত্রাণের আশায়। রোদ-বৃষ্টি, কাদা উপেক্ষা করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একমাত্র কাজ হচ্ছে ত্রাণ সংগ্রহ করা।
এ দিকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি, কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়া এলাকায় প্রতারকচক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এমনকি তারা অসহায় রোহিঙ্গাদের ত্রাণেও ভাগ বসাচ্ছে। বসতি গড়ে দেয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে নগদ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পৌঁছে দেয়ার কথা বলেও টাকা নিচ্ছে। ক্যাম্পগুলোতে থাকা পুরনো শরণার্থীরা নতুন শরণার্থীদের ত্রাণ কেড়ে নিচ্ছেন। হাজার হাজার শরণার্থী এখনো কোনো ক্যাম্প খুঁজে না পেয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। গতকালও ওপারে মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়। ওপারের মিজানপুরের বাসিন্দা এক রোহিঙ্গা বলেন, গত বৃহস্পতিবার মিজানপুর জামেয়া মাদরাসায় আগুন লাগিয়ে দেয় বর্মি সেনা এবং উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা।
বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা : সীমান্ত এলাকায় ঘুরে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে ও গত দুই দিনে যেসব শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, এখনো অন্তত সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আছেন। এরা বেশির ভাগই বুচিডং ও রাসিডংয়ের বাসিন্দা বলে জানা গেছে। এদের অনেক আত্মীয়-স্বজন ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন। তারা বলেছেন, দীর্ঘপথ হেঁটে পাড়ি দিতে তাদের খুব কষ্ট হয়েছে। কষ্ট করে তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও সীমান্ত এলাকায় পৌঁছেছেন। তারা এ দেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আছেন। কখনো পাহাড় বেয়ে, কখনো জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, আবারো কখনো নদী-সমুদ্র, বিশাল জলাশয় পেরিয়ে তাদেরকে বাংলাদেশে আসতে হচ্ছে।
অনেকে গত ২৫ আগস্ট বাড়িঘর ছেড়েছেন কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পৌঁছতে পারেননি। গতকাল শুক্রবার সকালের দিকে টেকনাফের লম্বাবিল এলাকায় কথা হয় বুচিডংয়ের বলিবাজার এলাকার আব্দুল খালেকের ছেলে নবী হোসেন, নুর ইসলামের ছেলে নুর হাসিম, নুর হোসেনের ছেলে নুর কামাল, আব্দুল খালেকের ছেলে মো: ইউসুফসহ কয়েকজনের সাথে। তারা গতকাল লম্বাবিল সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে রইক্ষ্যং ক্যাম্পে উঠেছেন। তারা জানান, তাদের পরিবার-পরিজন ওপারে পূককুলে (পূর্বের পাহাড়) অবস্থান করছে। শনি-রোববারের মধ্যে তারা চলে আসবেন। তারা বলেন, ওই পাহাড়ের পাশে নাফ নদীর তীরে শীলখালী সীমান্তে আরো অন্তত দেড় লাখ রোহিঙ্গা জড়ো হয়েছেন। তারা ঝোপজঙ্গলে আছেন। বাংলাদেশের পথে আছেন আরো অন্তত দুই লাখ রোহিঙ্গা।
সীমান্ত এলাকা ঘুরে জানা যায়, রাসিডং ও বুচিডং এলাকা থেকে আসা এই রোহিঙ্গারা যে স্থানটিতে জড়ো হয়েছেন সেটি তিন রাস্তার সংযোগস্থল। সড়কের একদিকে মংডু, একদিকে বুচিডং এবং এই দু’টি রাস্তার সংযোগস্থলে গিয়ে মিলেছে উনচিপ্রং থেকে আসা একটি রাস্তা। উনচিপ্রংয়ের বাংলাদেশ সীমানায় হলো টেকনাফের লম্বাবিল। রোহিঙ্গারা পূর্বের পাহাড়ের ওপর থেকে এসে জড়ো হয়েছেন শীলখোলায়। নুর কামাল ও ইউসুফ নামে দুই শরণার্থী জানিয়েছেন, ওই এলাকায় যারা জড়ো হয়েছেন তাদের অনেকের সাথে কথা তাদের হয়েছে। তারা সুযোগ বুঝে নাফ নদী পাড়ি দেবেন।
ত্রাণ বিতরণে এখনো নিয়ন্ত্রণ নেই : ত্রাণ বিতরণে এখনো প্রশাসনের কোনোই নিয়ন্ত্রণ নেই। গতকালও দেখা গেছে গাড়ি থেকে আকাশের দিকে ছুড়ে মারা হচ্ছে ত্রাণ। এর মধ্যে চাল-ডাল, রান্না করা খাবার, শুকনো খাবার ও পানীয় রয়েছে। এই ত্রাণ দৌড়াদৌড়ি করে সংগ্রহ করে নিতে গিয়ে অনেকেই আহত হচ্ছেন। অনেক ত্রাণদাতাকে দেখা যায় গাড়ি একদিকে চলছে অপর দিকে তারা ত্রাণ দিচ্ছেন। কে ত্রাণ পাচ্ছেন, কে পাচ্ছেন না সেদিকে কারো খেয়াল নেই। ফলে অনেক শরণার্থী আছেন যারা মোটেই ত্রাণ পাচ্ছেন না। আর যারা দৌড়ঝাঁপ করে সংগ্রহ করতে পারছেন তারা অনেক কিছুই পাচ্ছেন।
গাড়ি দেখলেই দৌড়ে আসেন ত্রাণের আশায় : উখিয়া থেকে টেকনাফ যাওয়ার রাস্তার দুই ধারে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছেন। তাদের অনেকেই গাড়ি দেখলেই দৌড়ে আসছেন ত্রাণের আশায়। যে কারণে অনেককেই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। এমনকি, সাধারণ যাত্রীবাহী গাড়িও তারা ঘিরে ধরেন ত্রাণের আশায়। না খেয়ে রয়েছেন এমন অনেক রোহিঙ্গা হাত বাড়িয়ে দিতে না পারায় কিছুই পাচ্ছেন না। গতকাল এমন অনেক নারী-পুরুষের দেখা মেলে। বালুখালী রাস্তার পাশে গতকাল নুর সাদিকা নামে এক বোরকা পরা তরুণীর সাথে কথা হয়। পাশেই ত্রাণ দিচ্ছিল লাইন দিয়ে। কিন্তু নুর সাদিকা সেখানে গিয়ে ত্রাণ নেননি। তিনি বলেন, বুচিডংয়ের একটি মাদরাসার ছাত্রী ছিলেন তিনি। সাড়ে সাত কানি সম্পত্তি তার বাবার। কোনো দিন হাত পেতে কিছু নিতে হয়নি। এখনও হাত পাততে পারছেন না। নুর সাদিকা বলেন, না খেয়ে থাকলেও তা করতে পারবেন না। এভাবে আরো অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের দেখা মেলে রাস্তার পাশে যারা হাত পেতে কিছুই নিচ্ছেন না। তবে কিছু কিছু ত্রাণদাতা রয়েছেন যারা এমন মানুষ খুঁজে বের করে তাদের হাতে অনেকটা গোপনে ত্রাণ তুলে দেন।
নতুন নতুন এলাকায় অগ্নিসংযোগ : প্রতিদিনই মিয়ানমারের কোথাও না কোথাও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে মিয়ানমারের মংডুর উত্তর সীমান্ত এলাকার বৃহত্তম মাদরাসা মিজানপুর জামিয়া মাদরাসায় বর্মি সেনা এবং মগরা আগুন লাগিয়ে দেয়। স্থানীয় সূত্র জানায়, মিয়ানমারের বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি হচ্ছে এটি। প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী এখানে শিক্ষা গ্রহণ করত। বাংলাদেশের উইঞ্চিপাড়ার ঠিক বিপরীতে মংডুর মিজানপুরে এই মাদরাসাটির অবস্থান। মিজানপুর এলাকার বাসিন্দা আব্দুস শুকুরের ছেলে নুর করিম এবং জমির হোসেনের ছেলে ওসমান গনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে ওই মাদরাসাটিতে আগুন লাগানো হয়। মাদরাসাটি অনেক বড়।
এ দিকে গতকাল মংডু শহরের শিকদার পাড়ায় একটি মুসলিম আবাসিক এলাকায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেখানকার মসজিদ দিয়ে অগ্নিসংযোগের সূত্রপাত করে বর্মি সেনারা। ওই আবাসিক এলাকায় অন্তত পাঁচ হাজার ঘর ছিল। ওখানে ধনাঢ্য পরিবারগুলো বসবাস করত। গতকাল টেকনাফের লম্বাবিল ও উইঞ্চিপাড়া সীমান্তে দাঁড়িয়ে দেখা যায় ওপারে অসংখ্য ঘরবাড়ি জ্বলছে।
গড়ে উঠছে প্রতারকচক্র : রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় প্রতারকচক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা অসহায় রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। গতকাল এমন একটি প্রতারক চক্রের ছয় সদস্যকে ধরে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের বাড়ি তৈরি করে দেয়ার নামে, তাদেরকে টিউবওয়েল, টয়লেট দেয়ার নাম করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্র।
পুরনো শরণার্থীদের ভাগ্য খুলেছে : পুরনো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভাগ্য খুলে গেছে। জানা গেছে, নতুন শরণার্থীদের ত্রাণে তারা ভাগ বসাচ্ছেন। তারা পুরনো হওয়ায় এবং দীর্ঘদিন বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করায় টেকনাফ, উখিয়ার বিভিন্ন এলাকা চেনেন। তারা এখন নতুন রোহিঙ্গা সেজে ত্রাণ সংগ্রহে মাঠে নেমেছেন। পুরনো রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা নেতা রয়েছেন ত্রাণ দেয়ার সময় তারা সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন। ফলে তারা পুরনোদের মুখ চিনে চিনে ত্রাণ দিচ্ছেন। তারা জানেন কোথায় বেশি ত্রাণ পাওয়া যায়। ফলে সেখানে গিয়ে তারা উপস্থিত হন। আর নতুনরা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি কোথায় ত্রাণ পাওয়া যায় এবং কোথায় পাওয়া যায় না। তারা এখানে সেখানে তাই ঘোরাঘুরি করেন।
আরো ২ জনের লাশ উদ্ধার : নাফ নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় আরো দু’টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল শাহপরীর দ্বীপ থেকে লাশ ২টি উদ্ধার হয়। এর মধ্যে একটি রোহিঙ্গা শিশু এবং অপর এক মাঝির লাশ। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ১১৩টি লাশ উদ্ধার হলো। গত ৩০ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে ৩৩টি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে।-নয়াদিগন্ত
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস