মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:৩২:১৩

সেনাবাহিনী ও মগদের ১৩ ধরনের অপরাধ

সেনাবাহিনী ও মগদের ১৩ ধরনের অপরাধ

নিউজ ডেস্ক : আমেনা বেগম। তার বয়স যখন ১৪ বছর তখনই বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের দেড় বছরেই জন্ম হয় প্রথম সন্তানের। নাম রাখেন সিহাব। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের শিকার হন আমেনা বেগম। সেনাসদস্যদের নির্যাতনের সময় চিৎকার করে কাঁদতে থাকে চার বছরের সিহাব। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয় শিশুটিকে। আমেনা বেগমের ওপর যখন পাশবিক নির্যাতন চলছিল তখন তিনি এ দৃশ্যও দেখেন। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আমেনা বেগমের ঠাঁই মিলেছে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে।

আমেনা বেগমের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুরতার বর্ণনা লিখে কতটুকু বোঝানো সম্ভব সেটি বড় প্রশ্ন। এসব ঘটনা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে উল্লেখ করেছেন দেশি বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে নির্যাতনের নানা চিত্র উঠে আসছে। এসব চিহ্ন শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু। টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে ও শারীরিক চিহ্নে নির্যাতনের বিষয়ে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে রাখাইনে ১৩ ধরনের মানবাধিকার অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে গণহত্যা, গুলি করে হত্যা, গলা কেটে হত্যা, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, পিটিয়ে হত্যা, পানিতে চুবিয়ে হত্যা, নারী-শিশুদের নির্যাতন, রকেটলঞ্চার আক্রমণ, হেলিকপ্টার থেকে বোমা ফেলে হত্যা, লুটপাট, বসতভিটায় অগ্নিসংযোগ, জমি দখল ও নিজের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ। গত এক মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর এসব করেছে।

মো. সেলিম ও মাওলানা সৈয়দ আলমের সঙ্গে কথা হয় গতকাল সকালে। দুজনেই মোটামুটি পড়াশোনা করার কারণে বাংলা ভাষাটাও অল্পবিস্তর বুঝতে পারেন। নিজ দেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর থামবাজারের বাসিন্দা সেলিম পেশায় ছিলেন স্কুল শিক্ষক। মাওলানা সৈয়দ আলম একটি মাদ্রাসায় পড়াতেন। উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে বসে তারা দুজন জানান ভিন্ন ধরনের কিছু নির্যাতনের কথা। তাদের গ্রামে তখনো সেনারা ঢোকেনি। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় দেখলেন, চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ আর ধ্বংসলীলা। বিষয়টির বর্ণনা দিয়ে মো. সেলিম বলেন, পরে জানতে পারি ওইটা লইঞ্চা (রকেটলঞ্চার) ছিল। এক সন্ধ্যার ভয়াবহতায় অনেক লোক মারা যায়। বেঁচে যাওয়া লোকজন ছুটতে থাকেন বাংলাদেশ সীমান্তে।

মগদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত যুবক ছেলেরা দলবেঁধে লাঠি ও রড নিয়ে নির্যাতনে নামে। কারো ওপর বেশি ক্ষিপ্ত হলে তাকে পিটিয়েই মেরে ফেলে। চালানো হয় নির্মম নির্যাতন।

সৈয়দ আলম বলেন, গলা কেটে ও পুড়িয়ে মারা সেনাদের দোসর মগদের কাছে এখন একটা ফ্যাশন। সেনারা মারছে গুলি করে। আর নির্যাতনের জন্য সেনাবাহিনী এবং মগ উভয়েই সমান দায়ী বলে মনে করেন এ রোহিঙ্গা নাগরিক।

গত ২৫ আগস্ট সেনা ও পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে হামলার অভিযোগ এনে রাখাইনে জাতিগত নিধন শুরু করে মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর মগরা। রোহিঙ্গা নাগরিকদের ওপর চালানো হয় চরম বর্বরতা। নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নামে বাংলাদেশের টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএমের কর্মকর্তারা জানান, ২৫ আগস্ট থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় সোয়া চার লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করে। তবে কক্সবাজার জেলায় কর্মরত গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, গত এক মাসে অন্তত ৮ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ হাজার গর্ভবতী নারী। গতকাল পর্যন্ত ১৮৯টি সন্তানের জন্ম হয়েছে এসব রোহিঙ্গা শিবিরে। গত কয়েকদিনের তুলনায় গতকাল রোহিঙ্গাদের প্রবেশ বেড়েছে কয়েকটি পয়েন্টে।

যদিও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, গতকাল পর্যন্ত ৪ লাখ ২৯ হাজার ৩০৮ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার তথ্য রয়েছে তাদের কাছে।

নিবন্ধন কার্যক্রমে যুক্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কালাম মো. লুৎফুর রহমান বলেন, গত রবিবার পর্যন্ত নিবন্ধিত হয়েছে ১৬ হাজার ২৬৪ রোহিঙ্গা।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ বলেন, সন্ত্রাস দমনের নামে, অপারেশন ক্লিন হার্টের নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী দমন, পীড়ন, হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠনের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। দেশি বিদেশি সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা এবং নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের বক্তব্যে এ বিষয়গুলো উঠে আসছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গাদের শরীরেও অনেক নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে। সব মিলিয়ে নিঃসন্দেহে এটি একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ।
তিনি আরও বলেন, এই মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও অং সান সু চি অভিযুক্ত। তাদের বিচার হওয়া উচিত।

আমেনা বেগমের পাশের তাঁবুঘর হামিদা ও সিরাজ দম্পতির। ৭ সন্তানের মধ্যে তিন জনই প্রাণ হারিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে। তাদের গ্রামে হামলা শুরু হলে সবাইকে নিয়ে পালিয়ে আসেন সিরাজ। কিন্তু ওই তিন সন্তান তখন বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যায়।

হামিদা বেগম বলেন, ওইদিন যেসব শিশু খেলতে গিয়েছিল তারা কেউই বাংলাদেশে আসতে পারেনি। তাদের সবাইকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হত্যা করেছে বলে জানায় সেখান থেকে পালিয়ে আসা এক ব্যক্তি।

টেকনাফের রইক্ষ্যং শরণার্থী ক্যাম্পের একেবারে শেষ দিকে পাহাড়ের চূড়ায় আশ্রয় নিয়েছে খাদিজা আক্তার। স্বামী এবং চার সন্তান নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। শুধু ১২ বছর বয়সী বড় মেয়েকে আনতে পারেননি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দোসর মগরা ধরে নিয়ে যায় রহিমাকে। এরপর আর খোঁজ মেলেনি।

খাদিজা আক্তার জানায়, মেয়েটার ভাগ্যে কী ঘটেছে সেটি ভাবতে গেলেও গা শিওরে ওঠে। ওকে কোনোদিন ফিরে পাব কিনা জানি না। কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন খাদিজা। তার ছোট ছোট চার সন্তান চারপাশজুড়ে বসে পড়ে। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে তারা। খাদিজা তাদের দেখে। চার সন্তানের উপস্থিতি হয়তো আরও বেশি মনে করিয়ে দিয়েছে খাদিজার অভাবকে। প্রিয় বড় মেয়েই যে তাকে মাতৃত্বের সাধ পূরণ করিয়েছিল।

খাদিজার স্বামী কাসেম বললেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী শুধু নারীদের নয়, ছোট ছোট মেয়ে শিশুদের দিয়েও তাদের লালসা চরিতার্থ করেছে।
সূত্র : আামদের সময়
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে