বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০৯:৪৮:৩৩

'তুমি ঘরে গিয়ে দেখো পাঁচজন রোহিঙ্গা নারী বসে আছে'

'তুমি ঘরে গিয়ে দেখো পাঁচজন রোহিঙ্গা নারী বসে আছে'

আলফাজ আনাম : উখিয়ার থ্যাংখালি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে স্থাপন করা হয়েছে শরণার্থীদের জন্য বিরাট একটি ক্যাম্প। স্কুলের পাশে একটি পাকাবাড়ি। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটি বাঁশঝাড়। এই বাঁশঝাড়ের পাশ ঘেঁষে কালো প্লাস্টিকের তাঁবু খাটিয়ে কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বাড়ির সামনে রোহিঙ্গাদের এই ঝুপড়ি নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়েছেন বাড়ির মালিক জিয়া আহমেদ। তিনি মিয়ানমার থেকে কাপড় এনে কক্সবাজারে বিক্রি করেন। তিনি জানালেন, রোহিঙ্গাদের থাকা ও খাওয়ার সমস্যার চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মলত্যাগ, পয়ঃনিষ্কাশন ও খাবার অভাব। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জিয়া যখন রোহিঙ্গাদের সমস্যার কথা জানাচ্ছিলেন তখন তার চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে বাড়ির সামনে মলত্যাগ। রোহিঙ্গারা স্কুলের মাঠে আশ্রয় নিয়েছে। কবে স্কুল খুলবে। বাচ্চারা স্কুলে কবে যাবে তা নিয়েও তিনি হতাশা প্রকাশ করলেন।

জিয়া আহমেদের এমন কথা শোনার পর প্রশ্ন ছিল- তাহলে এদের আশ্রয় দেয়াটা মনে হয় সরকারের ঠিক হয়নি। এখন তো দেশের মানুষ বড় সমস্যার মধ্যে পড়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে জিয়ার চেহারা বদলে গেল। স্পষ্ট জবাব। না। আমাদের কষ্ট হলেও ওরা থাক। জিয়া আহমেদের পাল্টা প্রশ্ন তুমি মুসলমান? বললাম হ্যাঁ, কোনো মুসলমান তো চাইতে পারে না আরেকজনের জান যাক। বার্মা গেলে ওরা তো মারা যাবে। রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর তার ব্যবসায় বন্ধ হয়ে গেছে। এরপরও এ পর্যন্ত ১০ হাজার টাকার খাবার কিনে দিয়েছেন তার বাড়ির পাশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের। আমি যখন খাই তখন আমার সামনে এরা না খেয়ে থাকে। আমি মুসলমান তারাও মুসলমান, তারাও তো আমাদের ভাই। খাবার সময় তাদের কাউকে-না-কাউকে সাথে নিয়ে খাই।

বাড়ির সামনে এভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেয়ায় তার স্ত্রী বিরক্ত কি না জানতে চাইলে বললেন, তুমি ঘরে গিয়ে দেখো পাঁচজন রোহিঙ্গা নারী বসে আছে। এরা সবাই এসেছে জিয়ার বাথরুমে গোসল করতে। বললেন, তার স্ত্রী প্রতিদিন নামাজ পড়ে দোয়া করে আরাকান যেন স্বাধীন হয়। এদের ওপর জুলুম যেন শেষ হয়। জিয়া আহমেদের মতো উখিয়া-টেকনাফের অসংখ্য মানুষ রোহিঙ্গাদের এভাবে আশ্রয় ও খাবার সরবরাহ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের এ দু’টি উপজেলায় মোট জনসংখ্যার চেয়ে প্রায় তিন গুণ মানুষ এখন অবস্থান করছে। স্থানীয় মানুষের জীবনযাপনের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। গ্রামে পাহাড়ের ঢালে, দোকানের সামনে এমনকি ধানক্ষেতের আইলেও রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে মায়ের কোলে শিশুরা কাঁদছে। এমনকি ধানক্ষেতে শিশু জন্মদানের মতো ঘটনাও ঘটছে। এই দুর্ভোগ ও অমানবিকতায় প্রথম সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন উখিয়া ও টেকনাফের সাধারণ মানুষ। এর পেছনে প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করছে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়ন ও গণহত্যার কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রথম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় এ দেশের সাধারণ মানুষ। সাহায্যর জন্য যারা গেছেন বা যাচ্ছেন তারা কেউ কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির ডাকে যাননি। তারা গেছেন বিবেকের ডাকে। মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। সরকারি ও আন্তর্জাতিক সাহায্যের আগে সাধারণ মানুষের সাহায্য রোহিঙ্গাদের কাছে পৌঁছে গেছে। ভিটেমাটিছাড়া অসহায় এই মানুষগুলো খোলা আকাশের নিচে দিনের পর দিন পার করলেও কেউ না খেয়ে ছিলেন না। এর কারণ যার যা সামর্থ্য ছিল তা নিয়ে খাবার কিনে পাঠিয়েছেন। এখনো প্রতিদিন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আসছেন। এখন সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের কারণে আরো শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। সাধারণ মানুষ যেভাবে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে তা ছিল এক কথায় অভূতপূর্ব। আসলে গোটা বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।

২.
কক্সবাজার জেলার দুই উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফের জনসংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখ। এর মধ্যে টেকনাফে তিন লাখ এবং উখিয়ায় আড়াই লাখের মতো। ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিধন শুরু হওয়ার পর থেকে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করে। নাফ নদী পার হয়ে কিংবা স্থল সীমান্ত পার হয়ে যারা এসেছে সবাই এ দুই উপজেলাতে আশ্রয় নিয়েছে। ইউএনএইচসিআর এবং সরকারি হিসাব মতে, এ পর্যন্ত সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যদিও স্থানীয় মানুষদের ধারণা এ সংখ্যা আরো বেশি হবে। এ ছাড়া আগে থেকে অন্তত দুই লাখ রোহিঙ্গা এই দুই উপজেলায় অবস্থান করছিল। সব মিলিয়ে প্রায় সাত লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা নাগরিক এখন টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় অবস্থান করছে। নির্ধারিত ক্যাম্পসহ দুই উপজেলায় অন্তত ৫ হাজার একর পাহাড়ি এলাকায় রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। রোহিঙ্গারা এখনো আসছে। এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিশ্চিত নয়।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন ও নির্মূল করতে যে অভিযান চালাচ্ছে, তাতে তারা পুরোপুরিভাবে সফল হয়েছে। রাখাইনে কত রোহিঙ্গা বসবাস করত তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বিভিন্ন তথ্যে দেখা যাচ্ছে, রাখাইন প্রদেশে ১২ থেকে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা বাস করত। এর মধ্যে অর্ধেক ইতোমধ্যে চলে এসেছে বাংলাদেশে। কত লোককে হত্যা করা হয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান হয়তো কখনোই পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছিলেন তিন হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। কিন্তু বাস্তবচিত্র সম্ভবত আরো ভয়াবহ। সংখ্যাটি বহু গুণ বেশি হবে। উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিবারগুলোর সাথে কথা বলে দেখা গেছে, এমন কোনো পরিবার নেই যে পরিবারের কাউকে না কাউকে মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা গুলি বা জবাই করে হত্যা করেনি। বিশেষ করে শিশু কিশোরদের সামনে তাদের মা-বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। নারীরা হয়েছে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখলে দেখা যাবে ৬০-ঊর্ধ্ব পুরুষ, নারী ও শিশুদের সংখ্যা যত বেশি সে তুলনায় যুবক ও যুবতীর সংখ্যা একেবারেই কম। পরিবারের যুবক-যুবতীরা কোথায়? জানতে চাইলে শুনতে হয়েছে সন্তানহারা বাবা-মা কিংবা স্বামীহারা নারীর আহাজারি। তরুণদের বাছাই করে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যার পাশাপাশি তরুণীদের ধর্ষণের পর হত্যার বহু ঘটনার বিবরণ পাওয়া যাবে।

 ৩.
ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মিয়ানমারের রাখাইনে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত এক হাজার ৩০০ শিশুকে এ পর্যন্ত চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা বাবা-মা বা কোনো আত্মীয়স্বজনকে ছাড়াই বাংলাদেশে এসেছে। সাহায্য সংস্থাগুলো ধারণা করছে এসব শিশুর বাবা-মায়ের দুজনকেই অথবা বাবাকে মিয়ানমারে মেরে ফেলা হয়েছে। ১৫ লাখ মানুষের মধ্যে যদি এক হাজার ৩০০ শিশু বাবা-মা হারিয়ে থাকে তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় কত মানুষকে মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা হত্যা করেছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ও জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের হিসাব মতে, প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে, যার একটি বড় অংশই শিশু।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের একজন মোহাম্মদ নূর বলছেন, এসব শিশুর বাবা-মাকে মিয়ানমারের সেনারা মেরে ফেলেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সংস্থার হিসাব অনুযায়ী নতুন করে আসা শিশু সংখ্যা দুই লাখেরও বেশি। কক্সবাজারের রেড ক্রিসেন্টের কর্মকর্তা সেলিম মাহমুদ বলছেন, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা নারীদের অনেকেই তাদের জানিয়েছেন যে তারা সাথে করে এমন অনেক শিশুকে এনেছেন যাদের পরিবারের সদস্যদের তারা আসার সময় খুঁজে পাননি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে শরণার্থীদের ৬০ শতাংশ শিশু। এ ছাড়া ১৬ থেকে ১৮ হাজার গর্ভবতী নারী যারা শুধু জীবন বাঁচানোর তাগিদে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এসেছেন। এদের অনেকের স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। এই নারী ও শিশুরা সবচেয়ে অসহায় অবস্থায় রয়েছে।

৪.
বাংলাদেশের মানুষ মানবিক চেতনা আর মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ থেকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এ দেশের মানুষ তাদের পাশে থাকবে। কারণ নিপীড়ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোকে তারা কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য বা সরকারি সাহায্যের ভরসায় থাকলে হয়তো অনেক রোহিঙ্গা শুধু খাবারের অভাবে মারা যেত। দেখা দিত ভয়ঙ্কর এক মানবিক বিপর্যয়। এখন দরকার কয়েক হাজার গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। অভিভাবকহীন এসব শিশু বিশেষ করে কিশোরী ও মেয়েশিশুরা সহজেই মানবপাচারকারী চক্রের হাতে পড়তে পারে। বাবা-মা ও স্বজনহারা এই শিশুদের জন্য বিভিন্ন সামাজিক ও করপোরেট সংস্থাগুলো এগিয়ে আসতে পারে। এদের নিজ দেশে ফেরত না পাঠানো পর্যন্ত খাওয়া এবং ন্যূনতম শিক্ষার পরিবেশ দেয়া এখন জরুরি। অনেক শিশু যে নৃশংস দৃশ্য দেখেছে তাতে তারা একধরনের ট্রমা বা মানসিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে। তাদের চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন।

রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ এমনকি শিশুদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা ফিরে যেতে চান তাদের নিজ বাড়িতে। কেউ বাংলাদেশে থাকতে চান না। কারণ রাখাইন বা আরাকান তাদের পিতৃভূমি; সেখানে তারা বড় হয়েছেন। এ ভূমি থেকে চিরতরে উৎখাত হবেন তা কখনো তারা মেনে নেবেন না। কিন্তু তাদের একটাই প্রশ্ন নিজ ভূমিতে তারা কিভাবে ফিরবেন? আর ফিরলেও জীবনের নিরাপত্তা থাকবে কি?

এখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যেভাবে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে একইভাবে তাদের ফেরত পাঠানোর দাবিতে সোচ্চার থাকতে হবে। সরকারের ওপর চাপ রাখতে হবে যাতে আর ১০টি ইস্যুর মতো রোহিঙ্গা ইস্যু চাপা পড়ে না যায়। ভূরাজনৈতিক নানা খেলায় রোহিঙ্গা সমস্যা যেন স্থায়ীভাবে বাংলাদেশের কাঁধে না চেপে বসে। অব্যাহত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের ফেরত পাঠাতে হবে। যেমন ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়েছিল ১৯৭৮ ও ১৯৯২ সালে। আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার এখন বাংলাদেশের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। অং সান সু চি বলেছেন, যাচাইবাছাই করে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে হবে।

বাস্তবতা হচ্ছে- দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান হবে না। মিয়ানমার আলোচনার নামে কালক্ষেপণের কৌশল নিতে পারে। ইতোমধ্যে আমরা ভারত ও চীনের মতো বন্ধুরাষ্ট্রের ভূমিকা দেখতে পেয়েছি। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। আর এ জন্য দেশের ভেতর থেকে চাপ আসতে হবে। সাধারণ মানুষের সোচ্চার ভূমিকার মাধ্যমে এ চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব।

[email protected]
এমটিনিউজ২৪ডটকম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে