যশোর : এলাকায় মাথা নিচু করে চলাফেরা করা ফজলে রাব্বি নামের ছেলেটিই যে গুলশান হামলার হোতা তামিমের সহযোগী তা যশোরের শহরতলী কিসমত নওয়াপাড়ার বাসিন্দারা কল্পনাও করেননি। শনিবার সকালে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় একটি বাড়িতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তামিমের সঙ্গে নিহত হন রাব্বির। এরপর শনিবার রাতেই প্রতিবেশীরা জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রথম জানতে পারেন।
আজ রবিবার সকালে ওই এলাকায় রাব্বিদের দোতলা বাড়ির সামনে গিয়ে তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কাজী হাবিবুল্লাহর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। ‘মদিনা মনজিল’ নামের এই বাড়ির ওপরতলায় পরিবারসহ তিনি বসবাস করেন। নিচতলা ভাড়া দেওয়া। অনেক অনুরোধের পর কাজী হাবিবুল্লাহ নিচতলায় নেমে পর্দার আড়াল থেকে দু-একটি কথা বলে আবার দ্রুত ভেতরে চলে যান।
রোববার সকালে নিজ বাড়িতে সাংবাদিকদের কাছ থেকে ছবি দেখে ছেলেকে শনাক্ত করেন কাজী হাবিবুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘ছবিতে যাকে দেখা যাচ্ছে, সে আমারই ছেলে। আমরা লাশ নিতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করব।
হাবিবুল্লাহ জানান, আজ সকালে গোয়েন্দা সংস্থার দুজন কর্মকর্তা তাঁর বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে চলে গেছেন। শনিবার বিকেলে আমার ছেলে মারা গেছে- এটা আমি জানি। তার বিষয়ে রিপোর্ট করেন, আমার কোনো সমস্যা নেই। তবে আমার ছেলেকে যারা জঙ্গি বানিয়েছে, বিষ খাইয়েছে- সরকার তাদের কেন ধরছে না।’ লাশ আনবেন কি না জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘অবশ্যই আমার ছেলের মরদেহ আনব।’
রাব্বির এক প্রতিবেশী জানান, রাব্বি এলাকার ছেলেদের সঙ্গে খুব একটা মিশতেন না। তবে স্থানীয় মসজিদের ইমাম মো. ইয়াহহিয়ার সঙ্গে তার সখ্য ছিল। আরেক প্রতিবেশী বলেন, রাব্বি বাড়ির পাশে মসজিদে নামাজ পড়তেন। সেখানে ইমামতি করতেন মো. ইয়াহহিয়া। তিনিই রাব্বিসহ চার পাঁচজনকে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রয়াস চালান। বিষয়টি জানার পর স্থানীয় লোকজন ইয়াহহিয়াকে ওই মসজিদ থেকে বের করে দেন।
রাব্বিদের আরেক প্রতিবেশী মশিয়ার রহমান বলেন, রাব্বি বাড়িতে ল্যাপটপ ব্যবহার করতেন। কিন্তু ঘরে তার মা-বাবা ঢুকলেই তা বন্ধ করে দিতেন। তার বাসায় জিহাদের নানা বই পাওয়া যায়, যেগুলো তার বাবা নষ্ট করে ফেলেছেন।
প্রতিবেশী নাসরিন আক্তার বলেন, রাব্বিরা কেউই এলাকার লোকজনের সঙ্গে মিশতেন না। বাড়ির পাশে মসজিদে নামাজ পড়তেন। এই মসজিদে বিভিন্ন সময়ে এলাকার মুসল্লিরা আসতেন, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের লোকজনও আসতেন। রাব্বি যেদিন বাড়ি থেকে চলে যান, হুজুরদের সঙ্গেই গিয়েছিলেন।
একই এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যশোর সদর উপজেলা কমিটির ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন দোদুল বলেন, ‘রাব্বি এপ্রিলের প্রথম দিকে বাড়ি থেকে চলে যায়। যাওয়ার সময় সে তার বোনকে বলে যায়- ‘জিহাদের জন্য যাচ্ছি’। হাশরের ময়দানে দেখা হবে। তার চলে যাওয়ার পর কাজী হাবিবুল্লাহকে থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে সহায়তা করি।’
আফজাল হোসেন দোদুল বলেন, ‘গত রাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জে নিহত একজনের ছবি দেওয়া হয় আমার কাছে। আমি ছবিটি রাব্বির বাবাকে দেখাই। উনি তার ছেলে রাব্বিকে শনাক্ত করেন। তিনি ছবিটি দেখে ভেঙে পড়েন।’
গত মাসে যশোর পুলিশ জঙ্গি সন্দেহে যে পাঁচজনের ছবি ও নামসহ পোস্টার ছাপে, রাব্বির নাম ও ছবি ওই তালিকায় দুই নম্বরে ছিল। রাব্বি যশোর এমএম কলেজে পদার্থবিদ্যা (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। গত ৫ এপ্রিল তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। তার বাবা কাজী হাবিবুল্লাহ যশোর উপশহর ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ। ছেলে নিখোঁজের ব্যাপারে গত ৭ এপ্রিল যশোর কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন তিনি। ছেলের ফিরে আসার আকুতি জানিয়ে দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন।
যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, ‘এই ছেলেটা যাওয়ার পর তার বাবা জিডি করেন। প্রথমদিকে তিনি বলেছিলেন, বাড়ি থেকে না বলে চলে গেছে। কিন্তু ডিএসবি (পুলিশের বিশেষ শাখা) থেকে পরে আমরা জানতে পারি, সে যে জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে চলে গেছে, সেটা বাড়িতেও বলে গেছে। তার মা-বাবা ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে বহু চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি।’ রাব্বিকে যারা জঙ্গি বানিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।
যশোর এমএম কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মিজানুর রহমান বলেন, রাব্বি খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল। এসএসসিতে জিপিএ ৫ এবং এইচএসসিতে ৪.৬ পয়েন্ট নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করে। এমএম কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ত। প্রথমবর্ষেও সে ভালো রেজাল্ট করে। অধ্যক্ষ বলেন, নিখোঁজ ছাত্রদের বিষয়ে এখন নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে।
২৮ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম