এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : সামাজিক মর্যাদা, আর্থিক নিরাপত্তা ও দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে পারার কারণে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ক্যাডার পদ কোটি তরুণের পরম আকাঙ্ক্ষিত একটি বিষয়।
দেশের লাখো তরুণ তাদের সরকারি চাকরির বয়সের শেষ দিন পর্যন্ত বিসিএস ক্যাডার এমনকি নন-ক্যাডার পদের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন।
ক্যাডার পদের লড়াইয়ে কেউ প্রথম প্রচেষ্টায় সফল হন কেউবা বারবার চেষ্টার পরও প্রিলিমিনারি উতরাতে পারেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফারদিন খান প্রিন্স তিনটি বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রতিবারই ক্যাডার হয়েছেন! আসুন এই অদম্য মেধাবীর গল্পনা শুনি।
প্রিন্স ৪০, ৪১ ও ৪৩তম বিসিএসে অংশ নিয়ে তিনি যথাক্রমে বিসিএস শিক্ষা, বিসিএস পরিবার-পরিকল্পনা এবং সর্বশেষ বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র প্রিন্সের বাড়ি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার পরচক্রা গ্রামে। প্রাথমিক পাঠ শেষ করেছেন গ্রামের পরচক্রা-বাউশলা-হাড়িয়াগোপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে।
প্রিন্স জানান, পড়ালেখা জীবনের শুরুতে নামকরা ছাত্র ছিলেন না। ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত ছিলেন অলমোস্ট লাস্ট ওয়ান, ২৪ জনের মধ্যে রোল নম্বর ছিল ২৩। পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ করাবে না এমন একটা অবস্থা ছিল। কোনোমতে পাশ করে মাধ্যমিকে ভর্তি হন পরচক্রা পিবিএইচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ক্লাশ সেভেনে রোল নম্বর ছিল ৫ কিংবা ৬। ক্লাশ এইট ছিল তার জন্য টার্নিং পয়েন্ট। এই সময় থেকে পড়ালেখায় ভালো করা শুরু করেন। ২০১১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। একটার জন্য গোল্ডেন মিস হয়।
প্রিন্স জানান, স্কুলজীবন থেকেই তার স্বপ্ন তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। চাচা আব্দুস সবুর ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। এই চাচা ছিলেন তার অনুপ্রেরণার বাতিঘর। চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডার নিয়ে যেতেন। ক্যালেন্ডারে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা দেখে মুগ্ধ হতেন প্রিন্স। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জানতে জানতে মনের অজান্তেই স্বপ্ন তৈরি হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।
প্রিন্স বলেন, ‘চাচার মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাস, অপরাজেয় বাংলা, টিএসসির আড্ডার গল্প শুনে মনে হতো— আমিও একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব।’
মনের কোণায় লালন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের স্বপ্ন নিয়ে চলতে থাকা প্রিন্স ২০১৩ সালে কেশবপুর কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। এবারও তিনি জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু নিজের করা ভুলের জন্য সুযোগ হাতছাড়া হয়। ভুলক্রমে জেনারেল ইংলিশের পাশাপাশি ইলেকটিভ ইংলিশ পূরণ করায় চান্স হয়নি সেবার!
স্বপ্ন বুঝি শেষ— এমন উৎকণ্ঠায় ভেঙে পড়েন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না হলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়। যদিও সেখানে ভর্তি না হয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে ভর্তি হন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সেকেন্ড টাইম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ২০১৪ সালে সেকেন্ড টাইমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দেন। এবার আর ভুল হয়নি। মানবিক শাখা (খ ইউনিট) থেকে ৩৯০তম (এক্সাট পজিশন) হন। ইচ্ছা ছিল আইনে (ল) পড়বেন। কিন্তু সেটা না পেয়ে ভবিষ্যতে ক্যাডার হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।
প্রিন্সের বক্তব্য অনুসারে, তার বিসিএসের পথচলা শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বছর পার হওয়ার পর। ২০১৬ সালে ৩৫তম বিসিএসের রেজাল্ট হয়। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার আবাসিক হলের (সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) পাশের কক্ষের এক বড় ভাই অ্যাডমিন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে মিস্টি খাওয়াতে আসেন। এটা দেখে চরম ভালো লাগা কাজ করে। প্রিন্স অনুভব করেন— চেষ্টা করলে তিনিও এমন অবস্থানে যেতে পারবেন।
ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন বোনা শুরু। সেকেন্ড ইয়ার থেকেই টুকটাক বিসিএসকেন্দ্রিক পড়ালেখা শুরু করেন। এর আগে বাইরের কিছু বই- আন্তর্জাতিক রাজনীতি, বাংলা সাহিত্য ও সংবাদপত্র পড়ে কিছু জ্ঞান আয়ত্তে নেন। ধীরে ধীরে পুরোদমে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। নিয়মিত সেখানে পড়া শুরু করেন।
প্রিন্স জানান, প্রথমবারের মতো ৪০ তম বিসিএসে অংশ নেন। প্রথমবারই প্রিলি-রিটেন উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভা দেওয়ার সুযোগ হয় এবং প্রথমবারই মেলে শিক্ষা ক্যাডার হওয়ার সুযোগ। বিসিএসের রেজাল্ট হওয়ার আগেই একটা সুসংবাদ পান। দুদকের সহকারী পরিচালক পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। ফলে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান না করে দুদকে যোগদান করেন। মাঝখানে ৪১তম বিসিএসে পরিবার-পরিকল্পনা ক্যাডার আসে। কিন্তু সেখানে না থেমে আরও সামনে অগ্রসর হন। সর্বশেষ ৪৩তম বিসিএসে আসে আকাঙ্ক্ষিত বিসিএস অ্যাডমিন ক্যাডার।
ফারদিন খান প্রিন্স বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল প্রশাসনকেন্দ্রিক। দুদক খুবই ভালো লাগে। যে প্রকৃতির জব আমার পছন্দ দুদক তার সঙ্গে যায়। কিন্তু স্বপ্ন ছিল অ্যাডমিন ক্যাডার হওয়ার। সেটা পূরণ হয়েছে। এ সময় তিনি তার সর্বশেষ ভাইভা বোর্ডের ছোট্ট অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন। প্রিন্স বলেন, ভাইভা বোর্ডে পর পর দুবার ক্যাডার হয়েছি এমন তথ্য দেখে একজন স্যার জানতে চান— অ্যাডমিন ক্যাডার কেন ফার্স্ট চয়েস। আমি উত্তর দিই— ‘আমি এমন একটা এলাকা থেকে এসেছি যে গ্রামে আমিই প্রথম ক্যাডার। ক্যাডার হওয়ার পর অঞ্চলের অসংখ্য শিক্ষার্থী অনুপ্রাণিত। অ্যাডমিন ক্যাডার পেলে এলাকার শিক্ষার্থীরা আরও উৎসাহিত হবে। উপরন্তু সরাসরি সমাজ পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারব। এবার সফল না হলে আমি আবারও আসব।’ প্রশ্নকর্তা ইমপ্রেসড হন।
তিনবার অংশ নিয়ে তিনবারই ক্যাডার! এমন অনন্যসাধারণ সফলতার বিষয়ে প্রিন্স বলেন, ‘ফ্রি হ্যান্ড রাইটিংয়ের স্কিল ছিল। বিভাগকেন্দ্রিক পড়ালেখা কাজে দিয়েছে। রাজনীতি-সংবিধান বেশ ভালো আয়ত্তে ছিল। বিভাগের পরীক্ষার অভিজ্ঞতার সূত্রে অনেক বেশি লেখার প্র্যাকটিস ছিল। উইক জোন টার্গেট করি। ম্যাথে কিছুটা দুর্বলতা ছিল। কিন্তু বন্ধুববান্ধব ও নিজ প্রচেষ্টায় সেটা কাটিয়ে উঠি।’
শিক্ষার্থীরা কীভাবে বিসিএসের ভালো প্রস্তুতি নিতে পারে— এ বিষয়ে তিনি বলেন, প্রিলির পর একটি রুটিন করে নিয়মিত পড়লে ভালো ফল মিলবে। পরীক্ষার হলে ৩-৪ ঘণ্টা প্রশ্নের মার্কের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে লিখতে হবে। প্রিন্স বলেন, আমি খেয়াল রাখতাম যদি আমি নিজে খাতা দেখি তা হলে কি চাইতাম। সে অনুসারেই লেখার চেষ্টা করেছি। প্রথম প্রশ্নগুলোতে অনেক বেশি টাইম নিয়ে ফেললে শেষ করার সময় মেলে না। সময় ব্যবস্থাপনা একটি বড় বিষয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কৃতী শিক্ষার্থী বলেন, বিসিএস একটা লং জার্নি। আপস অ্যান্ড ডাউন (উত্থান-পতন) থাকবে। কিন্তু হতাশ হলে চলবে না। ম্যারাথন জার্নি হিসেবে নিতে হবে। অল্প অল্প করে গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হতে হবে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর নিয়ত ও সংকল্প থাকলে সফলতা আসবেই।