জাহিদুর রহমান তারিক, ঝিনাইদহ প্রতিনিধিঃ ঝিনাইদহে এলসি’র মাধ্যমে পাশ্ববর্তি দেশ থেকে পান আমদানীর কারণে লোকসানের মুখে পড়েছে পান চাষ। চাহিদা কমে যাওয়ায় চাষী ও ব্যবসায়ীদের লোকশানের বোঝা দিন দিন ভারি হয়ে উঠছে। পান উৎপাদনের জন্য অন্যতম বিখ্যাত ঝিনাইদহ। জেলার চাহিদা মিটিয়ে এখানে উৎপাদিত ৯০ ভাগ পান সরবরাহ করা হয় ঢাকা, চট্রগ্রাম, সিলেট সহ বিভিন্ন জেলায় যা দেশের মোট চাহিদার ২০ ভাগ পূরণ করে।
এবার জেলায় পানের আবাদ হয়েছে ২ হাজার ২শ’ ৮৫ হেক্টর জমিতে। প্রতিদিন বিভিন্নভাবে চাষীরা ক্ষেতের তোলা পান বাছাই করে সেগুলো নিয়ে আসে বাজারে বিক্রির জন্য। বর্তমানে বাজারে প্রতি পন পান বিক্রি হচ্ছে প্রকার ভেদে ২০ থেকে ১২০ টাকা, যা খরচের তুলনায় অনেক কম। ফলে লোকসানে অনেকেই ভেঙে দিয়েছেন পানের বরোজ।
ক্ষতিগ্রস্থ পানচাষীরা জানান, বাজারে পানের দাম একেবারেই কম। পান বিক্রি করে এখন আর আমাদের আগের মতো লাভ হয়না। লোকসানের বোঝা দিন দিন বাড়ছে। এতে করে পানের বরোজ ভেঙে দিতে হচ্ছে। আর এলসির মাধ্যমে পান আমদানীর কারণে লোকশানের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। তারা আরো জানান, এলাকা বেশ কয়েক বছর যাবৎ পানের গোঁড়া পচা রোগ দেখা দিচ্ছে। এতে একদিকে যেমন ফলন কম হচ্ছে, অন্যদিকে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে পান গাছ।
জানা গেছে, যশোরের বেনাপোল স্থল বন্দর, সাতক্ষীরার ভোমরা, দিনাজপুরের হিলি সহ বিভিন্ন বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আসছে পান। তবে সব থেকে বেশি পান আমদানি হয় বেনাপোল বন্দর দিয়ে। এই বন্দর দিয়ে ২০১৫ সালে ২৪৭৩ মে.টন এবং ২০১৬ সালে ৭৩০৪ মে.টন পান আমদানি হয়েছে। কাস্টমস্ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে ভারত থেকে এলসি’র মাধ্যমে প্রতি কেজি পান কেনা হয় ৫০ টাকা ৭০ পয়সা হারে। সেই পান বন্দরের শুল্ক পরিশোধ সহ নিদ্রিষ্ট গন্তব্যে পৌছাতে ব্যবসায়ীর মোট খরচ হয় ৮০ টাকা। এলসি’র কেজির পান দেশে এনে পন হিসাবে বিক্রি করা হয়। প্রতি কেজিতে প্রায় দেড় পন পান হয়।
এলসি’র মাধ্যমে ভারত থেকে আমদানি করা পান চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট, ফেনীর মজিদ মিয়া বাজার, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, নাঙোল কোর্ট, নাভের পটুয়া, কচুয়া, চাদপুর ও নোয়াখালীর মোজাফ্ফরগঞ্জ, হাজিগঞ্জ সহ বিভিন্ন এলাকার মোকামে চলে যায়। এসব জায়গা এলসি’র পান প্রতি পন বিক্রি হচ্ছে সব থেকে ভালো মানের টা ৯০ টাকা আর তুলনামূলক কম মানের টা ৬০ টাকা পন দরে। হরিনাকুন্ডু উপজেলার কুলবাড়িয়া এলাকার পান ব্যবসায়ী মানোয়ার হোসেন জানান, এই এলাকা থেকে পান কিনে সরবরাহ করা হয় চট্রগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, টঙ্গী সহ বিভিন্ন স্থানে।
আগে ১০ থেকে ১২ গাড়ি করে পান পাঠানো হয়েছে কুলবাড়িয়া এলাকা থেকেই। সপ্তাহে ৭ দিন-ই বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখন সপ্তাহে ৩ দিন দু-গাড়ী করে পান পাঠালেও বিক্রি হতে চায় না। এলসি পান আমদানীর কারণে আমাদের পানটা ব্যাপক আকারে মার খেয়ে যাচ্ছে। পান পাঠালেই লোকসান হতে হচ্ছে, লাভ একেবারেই থাকে না। আমের চারা এলাকার পান ব্যবসায়ী মানিক বিশ্বাস জানান, এলসি’র মাধ্যমে পান আমদানীর কারণে আমরা ব্যবসায়ীরা দাঁড়াতে পারছিনা।
তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি এলসি’র পান আমদানি যেন বন্ধ করা হয়। পান আমদানি বন্ধ হলে দেশীয় পানে চাহিদা যেমন বাড়বে তেমনি ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে, ভালদাম পেয়ে লাভবান হবেন চাষীরা। ঝিনাইদহ কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১০ সালের পর থেকে এলসি’র পান আমদানীর পরিমাণ বেড়েছে। যার দরুন দেশীয় পানের দাম কমেছে শতকরা ১৫ ভাগ।
ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাহ্ মো. আকরামুল হক জানান, এলসি’র পান আমদানীর কারণে চাষীরা পানের কম দাম পাচ্ছে। ব্যবসায়ীদেরও কিছুটা লোকশান হচ্ছে। তবে যদি এলসি’র পান আমদানি বন্ধ হয় তা হলে পানের বাজার পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
অন্যদিকে জেলা কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ নাজমুল আহসান জানান, এ জেলার চাষীরা একই জমিতে বারবার পান চাষের কারণে পানে গোঁড়া পচা রোগ দেখা দিচ্ছে। তাই গোঁড়া পচা রোগ প্রতিরোধের জন্য বারবার একই জমিতে পান চাষ না করার জন্য চাষদেরকে অনুরোধ করা হচ্ছে। তবে যদি কোনো চাষী চাষ করেই থাকে তা হলে তাকে রোগ প্রতিরোধে ফানজিসাইড ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে। সঠিকভাবে এ পদ্ধতি ব্যবহার করলে গোঁড়া পচা রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। বরজ ঘেরা, পানের চারা লাগানো থেকে শুরু করে প্রতি বিঘা জমিতে পান আবাদে খরচ হয় ২ লক্ষাধীক টাকা। চারা রোপনের ৬ মাস পর থেকেই সংগ্রহ করা যায় পান পাতা। ফলন, দাম ভালো হলে চাষীদের লাভ অন্তত ৫০ হাজার টাকা। একটি বরোজ থেকে ৫ বছরের বেশি সময় পান পাতা সংগ্রহ করা যায়।
২১ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস