সামছুজ্জামান শাহীন, খুলনা : এক সময়ের দাপুটে রাজনীতিবিদ সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাউদ্দিন ইউসুফ, বিএনপিদলীয় সাবেক স্পিকার অ্যাডভোকেট শেখ রাজ্জাক আলী ও আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমামের দরদি অভিভাবকত্ব এখন নেই। তাদের শূন্যতায় নড়বড়ে হয়ে গেছে জাতীয় রাজনীতিতে খুলনার শক্ত প্রতিনিধিত্ব। তবে সেই শূন্যতা ধীরে ধীরে পূরণ করছেন তরুণ নেতৃত্ব। ফলে পালা বদল ঘটছে খুলনার সার্বিক রাজনীতিতে।
জানা যায়, খুলনার রাজনীতিতে ষাটের দশকের বর্ষীয়ান নেতা সাবেক হুইপ আশরাফ হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য সেকেন্দার আলী ডালিম ও মহানগর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এম নুরুল ইসলাম রাজনীতির শেষ সময়ে বয়সের কাছে হার মেনেছেন। রাজনীতিতে একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী তালুকদার আবদুল খালেক ও বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আলী আসগার লবীর মতো প্রজ্ঞাবান নেতাও। তাদের জায়গায় দলীয়ভাবে শক্ত অবস্থান গড়তে সক্ষম হয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা আলহাজ মিজানুর রহমান এমপি। আর বিএনপিতে একক কর্তৃত্ব রয়েছে মহানগর সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জুর হাতে।
জানা যায়, খুলনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতিতে উত্থান-পতনের গল্পের শুরুটা হয়েছিল আরও কয়েক বছর আগেই। খুলনার রাজনীতি মানে একসময় শেখ হারুনুর রশীদ, বেগম মন্নুজান সুফিয়ান, অ্যাডভোকেট শেখ রাজ্জাক আলী, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমাম, তালুকদার আবদুল খালেক, এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা, এম নুরুল ইসলাম (দাদু ভাই), এস এম এ রব ও সেকেন্দার আলী ডালিমকে বুঝত দেশের মানুষ। এই নেতাদের অনেকেই একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। শুধু সেকেন্দার আলী ডালিম জাতীয় নির্বাচনে কখনো আওয়ামী লীগের হয়ে আবার কখনো বিএনপির হয়ে লড়েছেন। বিএনপি সরকারের আমলে অ্যাডভোকেট রাজ্জাক আলী জাতীয় সংসদের স্পিকার হয়েছেন। আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন তালুকদার আবদুল খালেক। কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এবং জাতীয় সংসদের হুইপ হয়েছিলেন এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা।
এই তিন নেতা ২০১৫ সালে জাতীয় নির্বাচনে দলীয় টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আগের মতো খাপখাইয়ে নিতে পারছেন না নিজেদের। বরং তাদের টপকে খুলনার প্রত্যন্ত এলাকার রাজনীতিবিদ ও স্কুল শিক্ষক খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বর্তমান সরকারের মৎস্য প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। আবার খুলনা মহানগরীর আওয়ামী লীগ দলীয় রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলায় ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনে দলীয় টিকিটি খুলনা-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য হয়েছেন, আলহাজ মিজানুর রহমান মিজান। বর্তমানে মহানগরী আওয়ামী লীগের বৃহৎ অংশ তার নেতৃত্বে চলছে। আবার খুলনা সদর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি তরুণ নেতা অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলামও দলীয়ভাবে শক্ত অবস্থান তৈরিতে কাজ করছেন। দলীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তিনি পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদেরও নেতা হিসেবে শক্ত নেতৃত্ব গড়ে তুলেছেন।
জানা যায়, সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী তালুকদার আবদুল খালেক গত খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর বাগেরহাট-৩ আসন থেকে দলীয় মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বর্তমানে খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে থাকলেও খুলনার মহানগরীর রাজনীতিতে তার সরব উপস্থিতি আগের মতো নেই। দলীয় কর্মকাণ্ডেও তার অংশগ্রহণ আগের চেয়ে কমে গেছে। একইভাবে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য এম নুরুল ইসলাম বিএনপির বিগত নির্বাহী কমিটিতে দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন, এবার কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন।
আজীবন আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করে আসা এই প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ভাষাসৈনিক জীবনের শেষদিকে এসে আর তাল মেলাতে পারেননি। বিএনপির সাবেক মহানগর সভাপতি ও খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলী আসগার লবী রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন ওয়ান এলিভেনের পর থেকেই। খুলনা বিএনপিতে বিভক্তির রাজনীতি শুরু হওয়ার পর থেকেই তিনি নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে শুরু করেন। এখন আর খুলনামুখী হন না। আর মহানগর বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বিএনপির নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) নির্বাচিত হয়েছেন।
দলীয় ‘এক নেতার এক পদ’ ভিত্তিতে মহানগর বিএনপির সভাপতি পদ ছাড়তে হতে পারে মঞ্জু। সে ক্ষেত্রে দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফখরুল আলম, যুগ্ম সম্পাদক অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ আরিফুর রহমান মিঠু, দফতর সম্পাদক এস এম আসাদুজ্জামান মুরাদ, মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি তরিকুল ইসলাম জহির আসতে পারেন সামনের সারিতে, নতুন নেতৃত্বে। ইতিমধ্যে মহানগর সম্মেলনের ডামাডোল বাজতেই খুলনার পাঁচ থানার মধ্যে খালিশপুর, দৌলতপুর ও খানজাহান আলী থানার নেতা-কর্মীরা একজোট হয়ে বর্তমান মহানগর কোষাধ্যক্ষ এস এম আরিফুর রহমান মিঠুর পক্ষে তাদের সমর্থন জানিয়েছেন প্রকাশ্যে।
দীর্ঘদিন ধরে খুলনার রাজনীতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ-জামান। তিনি বলেন, খুলনার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা, বিগত দিনে যারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তারা ঢাকায় গিয়ে নিজেদের খুলনার গণমানুষের প্রতিনিধি ভাবতে পারেননি। ফলে দীর্ঘদিন উন্নয়নবঞ্চিত ছিল এই জনপদ। এ ছাড়া জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতার অভাব রয়েছে আমাদের। কিন্তু খুলনায় সুস্থ ও সহনশীল রাজনৈতিক-সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছেন এখানকার রাজনীতিবিদরা। সারা দেশে রাজনৈতিক হানাহানি থাকলেও সবসময় খুলনা ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত। এই বাস্তবতা এক ধরনের স্বস্তি উপহার দেয়। তিনি বলেন, রাজনীতিতে দক্ষ, শিক্ষিত, সাহসী মেধাবী ও প্রজ্ঞাবান নেতার অভাব থাকলে যোগাযোগ-বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো কখনো সম্ভব হবে না। - বিডি প্রতিদিন
২৩ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস