খুলনা: আগুনে পুড়ে মৃত্যুর কোলে ঠলে পড়া‘‘ লিটনের গল্প হার মানায় সিনেমাকেও! জন্মের তিন মাস আগে বাবা মারা যান। জন্মের ১০ দিন পর মা। পরের চার বছর কেটেছে বড় বোনের কাছে। কিন্তু অন্যের সংসারে থেকে ভাইকে মানুষ করা সম্ভব ছিল না বোনের। এ জন্য শিশুকালেই তাকে দিয়ে দেওয়া হয় এতিমখানায়। সেখানে থেকেই কষ্ট করে লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। এরপর চাকরি নিয়ে ছুটে এসেছেন ঢাকায়। আর সেখানেই আগুনে পুড়ে শেষ হলো সব।
এই কাহিনী মিজানুর রহমান লিটনের। তিনি বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীতে এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা গেছেন। লিটনের বাড়ি খুলনার তেরখাদা উপজেলার কোদলা গ্রামে।
লিটনের মতো হতভাগা তার সন্তানও। পাঁচ বছর বয়সী বড় ছেলে তানিম বিষয়টি এখনও বুঝতে পারছে না। লিটনের দ্বিতীয় সন্তানটি অনাগত। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী মাসের ১০-১২ তারিখের দিকে পৃথিবীর আলো দেখবে শিশুটি। কিন্তু পৃথিবীতে সফল আগমন ঘটলেও জন্মদাতা পিতার মুখ কোনোদিনই দেখতে পাবে না শিশুটি!
ফাইল ছবি
সন্তান ও পরিবার নিয়ে কত স্বপ্নই না ছিল লিটনের। বনানীর বিভীষিকায় শুধু লিটনের শরীর নয়, পুড়ে ছাই হয়েছে সব স্বপ্ন! অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে তার পুরো পরিবারকে।
লিটনের বড় ভাই আলম শেখ জানান, বনানীর এফ আর টাওয়ারের ১০ তলায় একটি ফার্মে কাজ করতেন লিটন। আগুন লাগার পর স্ত্রীকে ফোনে বিয়ষটি জানান। এরপর তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। বিকেলেই তারা ঢাকায় ছুটে আসেন। রাতে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে লিটনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়।
তিনি বলেন, ‘ভোর রাতে লাশ বুঝে নিয়ে শুক্রবার সকাল ১১টায় তেরখাদার কোদলা গ্রামে এসে পৌঁছাই। জুমার নামাজের পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।’
শুক্রবার দুপুরে কোদলা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, শোকে বিহ্বল সবাই। লিটনের জন্য চোখের পানি ফেলছেন গ্রামবাসী। লিটনের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী তানিয়া বেগম রয়েছেন তার বাবার বাড়িতে। তবে ঘটনা শোনার পর তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন।
প্রতিবেশীরা বলেন, তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট লিটন। চার বছর বয়সে খুলনার সমাজসেবা অধিদপ্তরের এতিমখানায় ঠাঁই হয় তার। সেখান থেকে পড়ালেখা করেছেন তিনি। খুলনার আযম খান কমার্স কলেজ থেকে ২০০৪ সালে পাস করে ঢাকায় চাকরিতে যোগ দেন। ২০১২ সালে বিয়ে করেন পাশের গ্রামের তানিয়া বেগমকে। আমরা ভেবেছিলাম ছেলেটার কষ্টের দিন শেষ হয়েছে। কিন্তু এক আগুনে সবকিছু পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে।
লিটনের ভাবি আমেনা বেগম জানান, এপ্রিলের ১০-১২ তারিখ তানিয়ার বাচ্চা হওয়ার কথা রয়েছে। ৭-৮ তারিখে খুলনায় আসার কথা ছিল লিটনের। কিন্তু ও যে চিরতরে চলে আসবে এটা কেউই ভাবতে পারিনি। এই খবর শুনে স্ত্রী তানিয়া কাল রাত থেকেই সংজ্ঞাহীন। তার অবস্থাও ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে।
লিটনের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে সুমন শেখ বলেন, চাকরিতে ঢোকার পর থেকে লিটন কাকা আমাদের গ্রামের অনেক ছেলেমেয়েকে লেখাপড়ার জন্য টাকা দিতেন। ছুটিতে গ্রামে এলে বিভিন্ন মানুষকে সাহায্য করতেন। আর বলতেন, আমার মতো কষ্ট যেন কেউ না করে। তার মৃত্যুতে গ্রামের সব মানুষই কাঁদছে।