বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন, ২০১৬, ০৬:১১:৪২

মুড়িতে ভাগ্য বদল দুই গ্রাম মানুষের

মুড়িতে ভাগ্য বদল দুই গ্রাম মানুষের

উত্তম মণ্ডল: মুড়ি ছাড়া যেন ইফতার জমেই না। আর তা যদি হয় হাতে ভাজা, তাহলে তো কথাই নেই। রোজার মাসে এই হাতে ভাজা ভেজালমুক্ত মুড়ি তৈরিতে সরগরম খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার ছোট কড়িয়া ও শোলাকুড়া গ্রাম। সারা বছরই মুড়ি ভাজা হলেও রমজানে চাহিদা বেশি থাকায় তাদের ব্যস্ততারও যেন শেষ নেই। খুলনার খানজাহান আলী সেতুর পূর্ব পারের জাবুসা-বাইনতলা সড়ক ধরে ১০ কিলোমিটার এগোলেই ছোট কড়িয়া গ্রাম। সঙ্গে লাগোয়া শোলাকুড়া। ওই দুই গ্রামের ৪০টির মধ্যে প্রায় সব পরিবারই মুড়ি ভাজা ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। মুড়িকে জীবিকা করে তারা জয় করেছে অভাবকে।


গত মঙ্গলবার খুব ভোরে ছোট কড়িয়া গ্রামের একটি বাড়ির সামনের রাস্তায় দেখা মিলল বড় বড় কয়েকটি বস্তায় ভরে মুড়ি নিয়ে ভ্যান দাঁড়ানো। ভেতরে ঢুকতেই কানে এল মুড়ি ভাজার শব্দ। মধ্যবয়সী একজন গৃহিণী আরেক নারীকে নিয়ে মুড়ি তৈরিতে ব্যস্ত। সামনে মাটির চুলা। চার মুখের ওই চুলায় দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। চুলার দুই মুখে দুটি হাঁড়িতে বালু আর অন্য দুটিতে চাল। চাল একটু হলুদাভ হলেই নারকেলপাতার কাঠিতে বালুর তাপ ঠিক হলেই বালুর হাঁড়িতে চাল ঢেলে কাঠি দিয়ে বার কয়েক নাড়াচাড়া। অমনি হাঁড়ি ভরে গেল মুড়িতে। কড়িয়া গ্রামের গৃহিণী হেলেনা খাতুন প্রায় ২৫ বছর ধরে মুড়ি ভাজছেন। কথা বলার সময় সেখানে যোগ দেন তাঁর স্বামী শহিদুল্লাহ শেখ। বললেন, একসময় অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। খুব অভাবে কাটত দিন। এখন পাকা বাড়ি হয়েছে। ছয়টি গরু আছে। আছে বেশ কয়েকটি ছাগল। লাভের টাকায় এখন গরু মোটাতাজাও করছেন। শহিদুল্লাহ বললেন, দুই গ্রামে মুড়ির সঙ্গে জড়িত লোকজন সবাই এখন সচ্ছল।


তিনি বলেন, ভোর থেকেই প্রায় প্রতিটি বাড়িতে শুরু হয় মুড়ি ভাজার তোড়জোড়। চলে রাত আটটা পর্যন্ত। অনেকে নিজেরা চাল কিনে ভাজেন। আবার অনেকে চাল কিনে অন্যের বাড়িতে টাকা দিয়ে ভাজান। রোজার আগে প্রতিদিন প্রায় ১০০ কেজি বিক্রি হতো। বর্তমানে প্রায় ২৫০ কেজি বিক্রি হয়। সব খরচ বাদে ৫০ কেজিতে ৪০০ টাকার মতো লাভ থাকে। একসময় দিনমজুরি করে কোনোমতে পেট চালানো ওই গ্রামের মহিউদ্দীন মল্লিক মুড়ির ব্যবসা করে এখন অনেক সচ্ছল। মহিউদ্দীন বলেন, রোজার মাসে বেশি চললেও বারো মাসই মুড়ি ভাজার সঙ্গে জড়িত তাঁরা। হাতে তৈরি মুড়ি একটু কম ফুললেও স্বাদে-গন্ধে বাজারের অন্যান্য মুড়ির চেয়ে আলাদা। খালি লবণ-পানি ছাড়া তাতে আর কিছুই দেওয়া হয় না।


মুড়ি উৎপাদনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, ৫০ কেজি চাল থেকে ৪৩-৪৪ কেজি মুড়ি পাওয়া যায়। আর এই পরিমাণ মুড়ি তৈরিতে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। প্রতি কেজি মুড়ি পাইকারি ৬০ টাকা, খুচরা ৬২-৬৩ টাকায় বিক্রি হয়। খুলনা শহর, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার পাইকারদের দেওয়া চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করেন। পুরুষেরা ভোরে ভ্যানে করে খুলনা শহরের বিভিন্ন দোকানে মুড়ি নিয়ে বিক্রি করে দুপুরের মধ্যে বাড়ি ফেরেন। অনেকে আবার মাথায় বস্তা নিয়ে ফেরি করে খুলনা শহরের বিভিন্ন বাড়িতে ও মুদিদোকানে মুড়ি দেন।


জানা যায়, দেশ স্বাধীনের পরপর শোলাকুড়া গ্রামের উপেন মণ্ডল প্রথমে মুড়ি ভাজা ও বিক্রির কাজ শুরু করেন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে শোলাকুড়া ও মনিরুল ইসলামের হাত ধরে পাশের কড়িয়া গ্রামে তা ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে পাশের রামভদ্রপুর গ্রামেও এটি ছড়াতে শুরু করেছে। মনিরুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সেখানে মুড়ি ভাজা হচ্ছে। ভাজা ও বস্তাবন্দী করার কাজে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা এত ব্যস্ত যে দম ফেলার ফুসরত মিলছে না। তিনি জানান, মুড়ির ব্যবসা করে দেড় বিঘা জমির ওপর বাড়ি তৈরি করেছেন। বাড়িতে চারটি গাভীসহ আছে ১০টি গরু। নিজের জমির পাশাপাশি বর্গা চাষ করেন আরও ১৭ বিঘা জমি। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আশরাফুল আলম খান বলেন, এ দুই গ্রামের মানুষ মুড়িতে ভাগ্যোন্নয়ন ঘটিয়েছে। তবে এখন কারখানার মুড়ি আসায় এই শিল্প হুমকির মুখে পড়তে পারে। মুড়ির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কোনো সহযোগিতা চাইলে ভেবে দেখা হবে।-প্রথম আলো

২৩ জুন, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে