কুষ্টিয়া থেকে : গত বছর শারীরিক অসুস্থতার কারণে জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি ডালিম খাতুন। এবার পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য জোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। মঙ্গলবার মডেল টেষ্ট পরীক্ষা। প্রস্তুতিও বেশ ভালো।
তবে, প্রবেশপত্র তুলতে গিয়ে যখন জানতে পারে তার আর পরীক্ষায় অংশ নেয়া হচ্ছেনা তখন হতাশ হয়ে পড়ে সে। কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানায় ডালিম। সেখানেও কোন সদুত্তর নেই। উল্টো শিক্ষকদের কাছ থেকে অপমানের শিকার হতে হয়।
শেষ পর্যন্ত আবারও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না পারার গ্লানি আর শিক্ষকদের অপমান সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেয় সে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ ওই শিক্ষার্থীর পরিবার ও স্বজনেরা স্কুল ঘেরাও করে শিক্ষকদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনো মতেই শিক্ষার্থী ডালিমের এই আত্মহননের দায় স্বীকার করতে নারাজ। হৃদয় বিদারক এই ঘটনা ঘটেছে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার কেএসএম স্কুল অ্যান্ড কলেজের স্কুল শাখায়।
ডালিমের বড় ভাই রুবেল হোসেন জানান, মাস দুয়েক আগে মডেল টেস্ট পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য আমার ছোট বোন ডালিমকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে যায়। স্কুলের সহকারী শিক্ষক মাসুদ স্যার’র কাছে ফরম পুরণ বাবদ টাকা দিই। আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় গরুর দুধ বিক্রির টাকা তুলে দেয়া হয় মাসুদ স্যার’র হাতে।
বুধবার মডেল স্টেট শুরু। তাই আগের দিন মঙ্গলবার স্কুলে যায় প্রবেশপত্র নেয়ার জন্য। স্কুলের সহকারী শিক্ষক মামুনর রশিদ মাসুদ স্যার’র কাছে প্রবেশপত্রের জন্য বলা হলে তিনি জানান, তুমি তো পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না। কারণ তুমি মডেল টেস্টের জন্য টাকা জমা দাওনি। সহকারী শিক্ষক মাসুদের এমন কথা শুনে হতবাক হয়ে যায় ডালিম।
সে জানায়, আপনার হাতেই আমি ও আমার ভাইয়া এসে টাকা জমা দিয়েছি। আজ আপনি বলছেন টাকা দেইনি। স্যার আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। ডালিমের এমন কথা শুনে রাগান্বিত হন শিক্ষক মাসুদ।
তিনি জানান, তোমার পরীক্ষা দিয়ে কাজ নেই। তোমার তো চেহারা ভালো, তুমি মডেল টেস্ট না দিয়ে মডেলিং করো। এতে ভালো করবে। শিক্ষক মাসুদের এ কথা-বার্তা শুনে ডালিম ছুটে যায় অধ্যক্ষ মঞ্জুরুল ইসলাম ডাবলুর কাছে। সেখানেও কোন সদুত্তর মেলেনি। তখন দুপুর প্রায় ১২টা। কোনো প্রতিকার না পেয়ে হতাশ হয়ে একপর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে সে বাড়ি ফিরে আসে। এরপর ঘরের দরজা বন্ধ করে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে ডালিম।
ডালিমের বড় ভাই জানান, স্কুল থেকে বের হওয়ার পর ডালিম মামাতো ভাই রোমেলের কাছে শিক্ষকের এমন আচরণের কথা বলে কাঁদতে থাকে। ডালিমের মামাতো ভাই রোমেল জানান, ডালিম মোবাইল ফোনে শিক্ষকের এমন আচরণের কথা জানাতে গিয়ে কাঁদতে থাকে।
ডালিমের মৃত্যুতে শোকাবহ পরিবার। বাড়িতে বুধবারও চলছে আহাজারি। ভাই বোন আত্মীয়-স্বজনদেরও একই অবস্থা। ডালিমের মা ফুলি বেগম জানান, মেয়েটা খুব শান্ত। পড়ালেখায় বেশ মনোযোগী। ৫ ছেলে মেয়ের মধ্যে সবার ছোট সে। অভাব-অনটনের সংসারে গরুর দুধ বিক্রি করে পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে টাকা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মাসুদ স্যার মেয়েকে বাঁচতে দেয়নি। তার কারণেই মেয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে দাবি করেন ফুলি বেগম। আমি মাসুদ স্যারসহ জড়িতদের শাস্তি চাই।
চাচা নুর হোসেন জানান, মৃত্যুর কারণ হিসেবে যখন জানতে পারি স্কুলের শিক্ষকের অসদাচরণের কারণে ডালিমের মৃত্যু হয়েছে তখন এলাকার লোকজনসহ শিক্ষক মাসুদ ও অধ্যক্ষ মঞ্জুরুল ইসলাম ডাবলুর কাছে বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। অসংলগ্ন কথা-বার্তা বলেছে। হত্যায় প্ররোচণার দায়ে অভিযুক্ত শিক্ষক মাসুদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।
স্কুল পরিচালনা পর্ষদ’র সাবেক সদস্য কবরবাড়িয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম জানান, ডালিমের মৃত্যুর জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষই দায়ি। আমরা অভিভাবক হিসেবে এই ডালিমের মৃত্যুর জন্য অধ্যক্ষ ও সহকারী শিক্ষকের শাস্তি দাবি করছি।
তবে ডালিমের মুত্যুর বিষয়ে কেএসএম স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ সঠিক নয় দাবি অভিযুক্ত অধ্যক্ষ ও সহকারী শিক্ষকের। যদিও তাদের দু’জনের কথায় অমিল খুঁজে পাওয়া যায়।
অভিযুক্ত সহকারী শিক্ষক মামুনুর রশিদ মাসুদ জানান, ডালিম কখনই মডেল টেস্টের জন্য ফরম পূরণ করতে আসেনি। এমনকি টাকাও জমা দেয়নি। মঙ্গলবার প্রবেশপত্র নিতে আসার বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি। একই সঙ্গে আপত্তিকর কোনো কথাও বলেননি বলেও দাবি করেন তিনি।
অন্যদিকে, অধ্যক্ষ মঞ্জুরুল ইসলাম ডাবলু বলেন, প্রবেশপত্র নিতে এসেছিল ডালিম। কিন্তু ফরম পূরণ না করায় সে পরীক্ষার সুযোগ হারিয়েছে। এতে আামদের গাফিলতির কোনো সুযোগ নেই।
এ ব্যাপারে জগতি পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ আল আমীন জানান, বিষয়টি শুনেছি। তবে ডালিমের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ পাইনি।
এদিকে বুধবার সকাল ১০টার দিকে ডালিমের স্বজন ও এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে স্কুল ঘেরাও করে। তারা অধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করে অধ্যক্ষ ও সহকারী শিক্ষক মাসুদের ওপর চড়াও হয়। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এমটিনিউজ/এসএস