লালমনিরহাট: দারিদ্র্যের সাথে নিত্য লড়াই করে বেঁচে থাকা লালমনিরহাটের ভ্যানচালক ও চা বিক্রতার মেয়েসহ কয়েকজন হতদরিদ্র পরিবারের সদস্য মেধা ও যোগ্যতায় বাংলাদেশ পুলিশে চাকরি পেয়েছেন।
দীর্ঘ তিন বছর বেশ কিছু চাকরি নিয়োগ পরীক্ষায় আংশ নেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে বাতিল হয়েও নিরাশ হননি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনাহাট গ্রামের ভ্যানচালক আতিয়ার রহমানের মেয়ে আঁখি তারা। বড় শখ ছিল কোনো বাহিনীতে যোগদান করে গর্বিত সদস্য হিসেবে দেশের সেবা করা ও ভ্যানচালক বাবার অভাবের সংসারের হাল ধরা।
সেই লক্ষ্যে এসএসসি পাশ করে সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশে একাধিকবার চাকরি নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই শখ পূরণ হয়নি। এরই মধ্যে এইচএসসি পাশ করে অনার্সে ভর্তি হয়ে চালিয়ে যান পড়াশুনা।
সম্প্রতি লালমনিরহাটে ১০৩ টাকায় পুলিশে চাকরি দেয়া হবে বলে মাইকিং শুনে শেষ বারের মত চ্যালেঞ্জ নিতে পুলিশ লাইন মাঠে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন আঁখি তারা। তিন দিনের টানা প্রতিযোগিতায় নিজেকে যোগ্য বলে প্রমাণ দিতে সক্ষম হলে চূড়ান্ত ফলাফলে দশ জনের মধ্যে মেধায় চতুর্থ হন তিনি। ফলাফল দেখে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি। পরে পুলিশ সুপারের হাত থেকে অভিনন্দন স্বরুপ ফুল নেয়ার সময় আনন্দে কেঁদে ফেলেন নিয়োগ পরীক্ষার মাঠে।
আঁখি তারা বলেন, ভ্যানচালক বাবার সামান্য আয়ে তিন ভাই বোনের লেখাপড়ার খরচ চালাতে গিয়ে অনাহারেও থাকতে হয়েছে। পরীক্ষার ফরমপূরণের সময় এলে টাকার চিন্তায় অনেক বার পড়াশুনা ছাড়তে চেয়েছি। কিন্তু নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে কষ্ট করেছি। এই দিনটার প্রতীক্ষায় ছিলাম। যেদিন অর্থ নয়, মেধা দিয়ে যোগ্যতা বিচার করা হবে। সত্যি সরকার ও জেলা পুলিশ সুপারের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ যে অর্থকে নয়, গরিবের মেধাকে মূল্যায়ন করেছেন।
আঁখি তারার বাবা আতিয়ার রহমান বলেন, কয়েকবার মেয়েটা ভাইভা পরীক্ষা দিয়ে বাতিল হয়েছে। অনেকেই বলেছে টাকা ছাড়া চাকরি হবে না। কিন্তু গরিব মানুষ টাকা কোথায় পাই। এবার মাইকিং শুনে মনে হয়েছিল যে টাকা ছাড়াই মেয়ের চাকরি হবে। আল্লাহ আমার ডাক শুনেছেন।
তাদের প্রতিবেশী দেলোয়ার হোসেন ও আজিজার রহমান বলেন, আঁখি তারার চাকরি দেখে আমরা নিশ্চিত এখন মেধাবীরা চাকরি পায়। কারণ আঁখি তারার পরিবার এক বেলা খেলে অন্য বেলা উপোস থাকে।
হাতীবান্ধা রেলস্টেশনের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাজারে ছোট্টা একটা খুপড়ি ঘরে চা বিক্রি করেন মহুবার রহমান। অভাবের সংসারে বড় মেয়ে মৌসুমীকে অনেক কষ্টে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াচ্ছেন। স্থানীয়দের সাহায্যে এসএসসিতে ফরমপূরণ করেন মৌসুমী। পুলিশে চাকরির মাইকিং শুনে মেয়েকে পুলিশ লাইনে নিয়োগ পরীক্ষায় নিয়ে যান মহুবার রহমান। কোনো রকম টাকা ছাড়াই মৌসুমী পুলিশ কনস্টবল পদে নির্বাচিত হওয়ায় যথারীতি হতভম্ব তারা। টাকা ছাড়া পুলিশে চাকরি তাদের কাছে পৃথিবী জয়ের আনন্দ।
চা বিক্রেতা মহুবার রহমান বলেন, কখনো ভাবিনি আমার মত গরিবের মেয়ের পুলিশে চাকুরী হবে। মেয়ের বিয়ে দেয়ার টাকা নিয়ে ভাব ছিলাম। কিন্তু সেই মেয়ে এখন সংসারের হাল ধরতে পারবে। এজন্য পুলিশ সুপারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তাদের প্রতিবেশী স্কুলশিক্ষক সোহেল রানা বলেন, প্রথম দিকে মাইকিং শুনে অনেকেই অট্টহাসি দিলেও মৌসুমীর চাকরিই প্রমাণ করে পুলিশের মাইকিং স্বার্থক।
শুধু আঁখি বা মৌসুমী নয়, হতদরিদ্র পরিবারের সদস্য হয়েও পুলিশে নিয়োগ পেয়েছেন অনেকেই। খোচাবাড়ি এলাকার দিনমজুর আনোয়ার হোসেনের ছেলে মনিরুল ইসলাম, কালীগঞ্জ করিমপুরের বর্গাচাষি মেহের আলীর ছেলে এনামুল হক, তিস্তা রতিপুরের বিমল চন্দ্রের মেয়ে প্রমিলাসহ অনেকেই।
মেধাকে মূল্যায়ন করায় এমন হতদরিদ্র পরিবারের লোকজন চাকরির সুযোগ পেয়েছেন বলে দাবি স্থানীয়দের।
লালমনিরহাট পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হক বলেন, পুলিশ বাহিনীকে দক্ষ করতে মেধাবী নিয়োগের বিকল্প নেই। তাই ঊর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় কোনো তদবির ছাড়াই যোগ্যদের কনস্টবল ট্রেইনি পদে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। ২৬জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত কয়েক ধাপে পরীক্ষা শেষে সহস্রাধিক প্রার্থীর মধ্যে ২৭ জনকে চূড়ান্ত নির্বাচন করা হয়েছে। যার মধ্যে ১০জন নারী ও ১৭জন পুরুষ। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্তরা মেধার পরিচয় দিয়ে আগামী দিনে পুলিশ বাহিনীর ভাবমুর্তিকে আরো উজ্জল করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।