নড়াইল : মা-বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটি সব সন্তানের জন্যই কষ্টকর। তবে নীহার বালার কষ্ট আলাদা, অমানবিক। কারণ এ দিনটি এলে সন্তান হিসেবে মর্যাদা না পাওয়া, অবহেলা আর নিগ্রহের কষ্ট তাঁকে ঘিরে ধরে। তিনি বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের পালিত কন্যা। সুলতানের মৃত্যুর পর নীহার বালাকে সুলতান কমপ্লেক্সে জায়গা দেওয়া হয়নি। ভিআইপিরা এলে তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তাঁর বাবাকে ঘিরে কোনো অনুষ্ঠানে তিনি দাওয়াতও পান না।
শিল্পী সুলতানের শেষ জীবন পরম যত্নে কেটেছিল পালিত কন্যা নীহার বালার কাছে। বলা হয়, এই নীহার বালার কারণেই ভবঘুরে জীবনের অবসান ঘটেছিল এই মহান শিল্পীর। শিল্পী সুলতানও তাঁকে মেয়ের মর্যাদা দিয়েছিলেন। এখন নীহার বালার জীবন বার্ধক্যে গড়িয়েছে। তীব্র শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগশোকে ভোগা, চোখ দুটির আলো নিভে যাওয়া এই অশীতিপর বৃদ্ধা এখন শয্যাশায়ী। প্রচণ্ড অভিমান নিয়ে বললেন, ‘বাবা মরে গেছে, আমিও মরে গেছি।’
আজ ১০ অক্টোবর সোমবার শিল্পী সুলতানের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটি উপলক্ষে এস এম সুলতান ফাউন্ডেশন, জেলা শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি নিলেও নীহার বালাকে যেন ভুলে গেছেন সবাই। বাবার মৃত্যুবার্ষিকীর সময়ই নীহার বালার ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার সময়। গতকাল পূজার অষ্টমী পেরিয়ে গেছে। আজ বাদে কাল দশমী। কিন্তু গতকাল রবিবার পর্যন্ত নীহার বালা পাননি সরকারের কাছ থেকে পাওয়া পাঁচ হাজার টাকার মাসিক ভাতা। পাননি চলতি বছরের চিকিৎসা ভাতাও। এই ভাতা বঞ্চনার কথা জানে না জেলা শিল্পকলা একাডেমিসহ সংশ্লিষ্ট কেউই।
বোহেমিয়ান জীবন শেষে ১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে শিল্পী সুলতান মাটির টানে দেশে ফিরে আসেন এবং নিজ-উদ্যোগে জন্মস্থান নড়াইলের মাছিমদিয়ায় ফাইন আর্ট স্কুল ও ‘শিশুস্বর্গ’ নামে শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ সময় নড়াইলের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়ে মানুষের সঙ্গে মিশেছেন ভবঘুরে সুলতান। কুড়িগ্রামে পৈতৃক জমিতে একটি ছোট ঘর ছিল তাঁর। এ সময় ১৯৭০ সালের দিকে তার জীবনে আবির্ভাব ঘটে পালিত কন্যা নীহার বালার।
সুলতানের জীবদ্দশায় পালিত কন্যা নীহার বালা তাঁর কাজের প্রেরণার উৎস হিসেবে থেকে তাঁর বোহেমিয়ান জীবনের ইতি টানতে পেরেছিলেন। তাঁর খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে রং তৈরি করার কাজ করে দিতেন নীহার বালা। সেই নীহার বালার সংসারে আজ তিনি বড় অসহায়। নীহার বালা থাকেন অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে একটি ঘরে। অসুস্থ হয়ে সেখানে পড়ে আছেন তিনি। সুচিকিৎসার অভাবে চোখ দুটি নষ্ট প্রায় দেড় বছর ধরে।
সম্প্রতি তাঁকে দেখতে গেলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, একবার এক অনুষ্ঠানে এসে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জান নূর তাঁকে একটি ঘর তৈরি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আজও সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি। নীহার বালার এখন একটাই চাওয়া, শেষ জীবনে তিনি একটু ভালোভাবে থাকতে চান, ভালো একটি ঘরে থাকতে চান।
লোক সংস্কৃতি গবেষক অধ্যক্ষ রওশন আলী বলেন, সুলতান বেঁচে থাকতে নীহার বালাই ছিলেন তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষ। আর আজ তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। সুলতানের পালিত মেয়ে হিসেবে নীহার বালার যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হোক, তাঁর ক্ষুদ্র চাহিদাগুলো পূরণ করে তাঁকে সন্তানের মর্যাদা প্রদান না করলে প্রকারান্তরে সুলতানকেই অসম্মান করা হবে। নড়াইলের জেলা প্রশাসক ও সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ জানান, নীহার বালা বার্ষিক চিকিৎসা ভাতা ও মাসিক ভাতা না পাওয়ার বিষয়ে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।
মৃত্যবার্ষিকী : ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বরেণ্য শিল্পী এস এম সুলতান। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এস এম সুলতান ফাউন্ডেশন, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, মূর্ছনা সংগীত নিকেতনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সংগঠন কর্মসূচির আয়োজন করেছে। -কালের কন্ঠ।
১০ অক্টোবর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম