নীলফামারী : নির্ঘুম রাত সবসময়ই দীর্ঘ লাগে। ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে আকস্মিকভাবে তিস্তার পানি বাড়ায় আতঙ্কে এ রকম নির্ঘুম একটি রাতই পার করছে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার নদী র্তীরবর্তী মানুষজন।
সোমবার (১০ সেপ্টেম্বর) বিকালের পর থেকেই বাড়তে থাকে তিস্তার পানি। সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিস্তা ব্যারাজের নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে নদীর বিপদসীমা অতিক্রম করে রাত ১২টা থেকে বিপদসীমার ২০ সেন্টমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে।
নদীর পানি আকস্মিকভাবে বাড়াতে থাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে তিস্তা নদীর র্তীরবর্তী নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, গয়াবাড়ি এবং জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের অন্তত ১৫টি চরগ্রামের মানুষের মাঝে।
এসব গ্রামের অনেক মানুষ রাত জেগে অন্যত্র আশ্রয়ের প্রস্তুতিতে ছিলেন। কেউ কেউ আবার রাত জেগে গ্রাম রক্ষা বাঁধের কাজ করেছেন। তবে মঙ্গলবার (১১ সেপ্টেম্বর) ভোরের দিকে নদীর পানি কমতে শুরু করলে স্বস্তি ফেরে এসব গ্রামের মানুষের মধ্যে।
এদিকে নদীর পানি বাড়ার পর থেকেই কর্তৃপক্ষ তিস্তা ব্যারেজের সব ক’টি জলকপাট খুলে রেখে পানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নীলফামারীর ডালিয়া বিভাগের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে রংপুর পাউবো শাখা কর্মকর্তা আমিনুল রশীদ জানান, ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সোমবার বিকাল থেকে তিস্তা নদীর পানি বাড়তে থাকে। সন্ধ্যা ৬টায় তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে নদীর বিপদসীমা অতিক্রম করে রাত ১২টায় ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
তবে মঙ্গলবার সকাল ৬টায় ১২ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরপর সকাল ৯টায় বিপদসীমার দুই সেন্টিমিটার নিচে নামে। বেলা ১২টায় বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার এবং বিকাল ৩টায় বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে জানান তিনি।
তিস্তা নদীর নীলফামারী ডালিয়া পয়েন্টে নদীর পানির বিপদসীমা ৫২ মিটার ৬০ সেন্টিমিটার। এদিকে নদীর পানি বাড়ার পর থেকেই তিস্তা ব্যারেজের সবক’টি জলকপাট খুলে রেখে পানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে নদীর র্তীরবর্তী এলাকার মানুষ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, সোমবার সন্ধ্যা ৬টার পর থেকে নদীর পানি বাড়তে শুরু করে।
নদীর পানি ক্ষণে ক্ষণে বাড়তে থাকলে নদীর র্তীরবর্তী নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী, ঝুনাগাছ চাঁপানী, গয়াবাড়ি, জলঢাকা উপজেলার, গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ি, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের তিস্তা নদীবেষ্টিত প্রায় ১৫টি চর গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়ে।
পরিবার পরিজন নিয়ে এসব গ্রামের মানুষ রাত জেগে ঢলের পানি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। অনেকের বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করায় উঁচুস্থানে সরে যাওয়ারও প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে। তবে মধ্যরাতের পর থেকে পানি কমতে শুরু করলে অনেকটাই স্বস্তি ফিরে এসব মানুষের মাঝে।
তিস্তা ব্যারেজের ভাটিতে পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের বাইশপুকুর গ্রামের বিপুল চন্দ্র সেন বলেন, সন্ধ্যার পর থেকে আকস্মিকভাবে নদীর পানি বাড়তে শুরু করে। ক্রমাগত পানি বাড়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে বসবাসরত তিনশ পরিবারের মাঝে। এসময় গ্রামের স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাধটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মধ্যরাত থেকে নদীর পানি কমতে শুরু করলেও রাত জেগে বাধের ক্ষতি হওয়া এলাকা সংস্কারের কাজ করতে হয়েছে গ্রামের মানুষজনকে।
এদিকে পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের পূর্ব ছাতনাই গ্রামের একরাম আলী বলেন, সন্ধ্যায় হু হু করে নদীর পানি লোকালয়ে আসতে থাকে। পানি আসার গতিতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে গ্রামের মানুষ। রাতের বেলায় নদীর পানি বাড়ায় গ্রামের মানুষের মাঝে আতঙ্ক আরো বাড়তে থাকে। তাই আমরা সারা রাত জেগে ঢলের পানি মোকাবেলার প্রস্তুতিতে ছিলাম। এসময় খবর পাই, আমাদের গ্রামে স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বালুর বাধটিতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। রাত জেগে গ্রামের সব মানুষ বাধ রক্ষার কাজ শুরু করায় সেটি রক্ষা পায়।
একই উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম বলেন, তিস্তা নদীর পানি বেড়ে ইউনিয়নের পূর্বখড়িবাড়ি ও দক্ষিণখড়িবাড়ি মৌজায় পানি প্রবেশ করে। রাতে আকস্মিকভাবে নদীতে ঢলের পানি আসায় ওই দুই গ্রামের সহস্রাধিক পরিবার পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতিতে নির্ঘুম রাত কাটায়। পানির তোড়ে পূর্বখড়িবাড়ি গ্রামে স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাধটির ৪০০ মিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গ্রামবাসী রাত জেগে ওই বাধ রক্ষায় সচেষ্ট ছিল।
তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত বাধটির বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে। তিনি দ্রুত সংস্কারের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান বলেন, সোমবার রাতে নদীর পানি বাড়তে শুরু করলে আমার ইউনিয়নের নদী তীরবর্তী গ্রাম ঝাড়সিংহেশ্বর ও পূর্বছাতনাই গ্রামের মানুষ রাত থেকে সতর্কাবস্থায় ছিল। মঙ্গলবার সকাল থেকে নদীর পানি কমায় গ্রামের মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে।
নীলফামারীর পাউবো ডালিয়া বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল আলম চৌধুরী বলেন, সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলে ব্যারেজের সবক’টি গেট (৪৪) খুলে রাখা হয়। রাত ১২টায় বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এরপর মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে নদীর পানি কমতে শুরু করে, যা বিকাল ৩টার দিকে নদীর বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, এখন পর্যন্ত কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. নাজমুন নাহার বলেন, গত সোমবার রাতে পানি বাড়লেও মঙ্গলবার সকাল থেকে নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তেমন কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর নেই আমদের কাছে। তবে পানি বৃদ্ধির ফলে টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নে স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাধটির সামান্য কিছু ক্ষতি হয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানে বালির বস্তা ফেলে বাধটি সংস্কারের প্রস্তুতি চলছে।