সাবিবুর রহমান সাবিব, পঞ্চগড় থেকে : ভোটযুদ্ধ করে পঞ্চগড়-২ আসনটি ধরে রাখা ও পুনরুদ্ধার নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। কোন দলের কে প্রার্থী, কার কী অবস্থান, কে প্রার্থী হলে ভোটের লড়াইয়ের চিত্র কেমন হবে তা নিয়ে চলছে নানা হিসাব নিকাশ ও বিশ্লেষণ।
সে সঙ্গে ওই দুটি দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি বাড়াতে কৌশলগত কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি লবিং-গ্রুপিংয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত পঞ্চগড়-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন পর পর দু’বার নির্বাচিত হয়েছেন।
এ আসন থেকে তিনি এবারও প্রার্থী হবেন। সুজন স্বচ্ছ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলেও এবার তার জয়লাভ করা সহজ হবে না। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হওয়াসহ দলের ও বাইরের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন বলে মনে করা হচ্ছে।
জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে গ্রুপওয়ারী প্রার্থী মনোনয়ন, সমর্থন ও বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে যে দ্বন্দ্বসহ দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসন না করা, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণের চাওয়া পাওয়া নিয়ে অসন্তোষ, অভাব অভিযোগ বলতে না পারা, নানা সমস্যা নিরসন নিয়ে বিড়ম্বনা।
এক শ্রেণির নেতাকর্মীর অবমূল্যায়ন, না পাওয়ার বেদনা, সুযোগ সন্ধানী নেতাকর্মীদের স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় ব্যাপক নিয়োগ বাণিজ্য, তদবির ও নানা কর্মকাণ্ড, টিআর, কাবিখা, কাবিটা ও নির্মাণ কাজে আর্থিক সুবিধা হাতানোর জন্য সমালোচিত হওয়ার কারণে তার এ অবস্থা দাঁড়িয়েছে।
নেতা-কর্মীদের কেউ কেউ বলছেন, সংসদ সদস্য হিসেবে তার অর্জন ও সফলতা অনেক। তিনি একজন ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত হলেও তার নাম ভাঙিয়ে কতিপয় নেতা বাণিজ্য, তদবির ইত্যাদি করার জন্য তিনি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছেন।
ওদিকে, এবার এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. মো. শাহজাহান। তার বাড়ি দেবীগঞ্জ এলাকায়। সুজন বিরোধী গ্রুপের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থক তাকে সহযোগিতা করছেন। তিনি পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে ইউনিয়ন পর্যায়ে কয়েকবার শোডাউন করাসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সক্রিয় রয়েছেন।
এদিকে, এ আসনটি এক সময় বিএনপির দখলে ছিল। কিন্তু নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দখলে চলে যায়। আসনটি থেকে ৪ বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মরহুম মোজাহার হোসেন মারা যাওয়ার পর এখানে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থীর সংকট দেখা দেয়। এখন পর্যন্ত এ আসনে চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জাতীয়তাবাদী যুবদলের সহসভাপতি ফরহাদ হোসেন আজাদের নাম শোনা গেছে।
তিনি মাঝে মধ্যে ঢাকা থেকে এসে সংসদীয় এলাকায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগসহ নির্বাচনী প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে মনোনয়ন পরিবর্তনও হতে পারে বলে অনেকে মনে করছে। আজাদের বাড়ি বোদার পাঁচপীর ইউনিয়নে। সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম মোজাহার হোসেনের প্রচুর ভক্ত এবং বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের একটি বড় অংশ আজাদকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে ভোটযুদ্ধ করে জয়লাভ করতে পারবে এমন কোনো ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়ার জন্য কেন্দ্রে লবিং করছে।
বিএনপির নেতৃত্ব মোজাহারের কাছে থাকাকালীন সময়ে তার বিরুদ্ধে ফরহাদ হোসেন আজাদ সর্বক্ষেত্রে সক্রিয় ছিলেন। এতে মোজাহার পক্ষের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়াসহ আচার-আচরণ ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বিএনপির ওই অংশটি আজাদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তবে আজাদ মোজাহার পক্ষের নেতাকর্মীদের নিজের পক্ষে টানতে অনেকটা সফল হয়েছেন বলে জানা গেছে।
আজাদ সমর্থকরা বলেছেন, এখন পর্যন্ত আজাদের বিকল্প বিএনপির কোনো প্রার্থী না থাকায় নেতাকর্মীরা আস্তে আস্তে তার কাছে ভিড়ছে। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে এখনো ঘোষণা না দিলেও শেষ মুহূর্তে ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী হয়ে চমক দেখাতে পারেন বোদা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা মো. সফিউল্লাহ সফি। তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মনোনীতসহ বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিটি দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তিনি মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরকারি সুযোগ সুবিধাসহ অনুদান প্রদান, পরিষদ ও ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি শ্রেণির মানুষের সমস্যা সমাধানে আর্থিক সহযোগিতা করার পাশাপাশি নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন।
এবার নির্বাচনী মাঠে অন্যান্য প্রার্থীর জন্য ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিতে পারেন জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক এমরান আল আমিন। তিনি গত সংসদ নির্বাচনে মশাল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। তিনি জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোটের লড়াই করে চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ভোটে বোদা ও দেবীগঞ্জে প্রথম হয়েছেন। তিনি শরিক দলের নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মনোনয়ন চাইবেন। না পেলে জাসদের প্রার্থী হবেন।
উল্লেখ্য, পঞ্চগড়-২ আসনে আওয়ামী লীগের ৩৬ শতাংশ, বিএনপির ৩০ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ দল নিরপেক্ষ ভোটার রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ভোটার গ্রুপিং, কোন্দল ও প্রার্থী বিবেচনায় দলের বাইরে ভোট দিতে পারে। এসব ভোটারসহ দল নিরপেক্ষ ভোটারদের নিজের পক্ষে টানার কৌশলগত কার্যক্রম চালিয়ে যাবেন বলে এমরান আল আমিন জানিয়েছেন।
ফরহাদ হোসেন আজাদ বলেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমাকে ২ আসনে বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত করে এলাকায় কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। সংসদীয় এলাকার বেশির ভাগ নেতাকর্মী আমার সঙ্গে রয়েছে। ১০ শতাংশ নেতাকর্মী বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এদেরকে আমার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করাসহ দলের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় করতে চেষ্টা চলছে।
জামায়াত নেতা ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সফিউল্লাহ সফি বলেন, আমাকে ২০ দলীয় জোটের মনোনয়ন দিয়ে হাইকমান্ড থেকে নির্বাচন করার নির্দেশনা দিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য প্রস্তুত আছি। মনোনয়ন পেলে নির্বাচনে জেতার জন্য আমার সকল যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা রয়েছে।
অধ্যাপক এমরান আল আমিন বলেন, দলের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজনকে বিতর্কিত করে তুলেছে। এ আসনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু ভোটার রয়েছে। হিন্দু ভোটারসহ অনেকের মধ্যে না পাওয়ার বেদনা ও অসন্তোষ রয়েছে। আমি নির্বাচিত হলে সর্বস্তরের মানুষের প্রত্যাশা ও কল্যাণে কাজ করে যাব।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. মো. শাহজাহান বলেন, এ আসনের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নেতৃত্বের পরিবর্তন চায়। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে আমি সংসদ নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এজন্য সংসদীয় এলাকায় কয়েকবার শোডাউন করাসহ ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মাঠে নামার আগে মানুষের চাকরিসহ নানা উপকারে এগিয়ে গেছি এখনো যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস জরিপ হলে ৮০ শতাংশ নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের মানুষ আমাকে মনোনয়ন দেয়ার পক্ষে থাকবে।
সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, আমি স্বচ্ছ রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সমালোচনার ঊর্ধ্বে থেকে জনকল্যাণে রাজনীতি করে আসছি। এমপি হিসেবে সংসদীয় এলাকার জনগণের প্রত্যাশা ও দাবি পূরণসহ সমস্যা নিরসনে কাজ করে যাচ্ছি। নানাভাবে অনেকের উপকারও করা হচ্ছে। এতে দলের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল ও অবস্থান শক্ত হওয়াসহ জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের ভিক্তি খুবই শক্তিশালী। এখানে নৌকার ভোটও বেশি। সবাই তো জনগণের জন্য রাজনীতি করেনা। সুযোগ সন্ধানী কেউ কেউ আমার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকতে পারে। এক শ্রেণির নেতাকর্মীর বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাকে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি বা জানায়নি। টিআর কাবিখার প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব উপজেলা প্রশাসনের। কেউ অনিয়ম করলে ব্যবস্থা নেবে। দলের বা আমার সমালোচনা হয় এমন কোনো কাজ না করার জন্য নেতকর্মীদের নির্দেশনা দেয়া আছে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. মো. শাহজাহানের ব্যাপারে তিনি বলেন, তিনি তো দলের কোনো কর্মীও না। দলের কোনো কর্মকাণ্ডেও সম্পৃক্ত ছিলেন না। তার মনোনয়ন চাওয়ার যুক্তিসংগত কারণ দেখিনা। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি