মো. লুৎফর রহমান, পঞ্চগড় থেকে : দেশে এ পর্যন্ত পাওয়া প্রাচীন দুর্গনগরীগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ ভিতরগড় দুর্গনগরী। প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভিতরগড়। কিন্তু উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভিতরগড় এলাকায় গড়ে উঠেছে বিজিবির ক্যাম্প, চা-বাগানসহ নানা স্থাপনা।
প্রশাসনের অবহেলা আর স্থানীয় অধিবাসীদের অসচেতনতায় এভাবে একটু একটু করে ধ্বংস হচ্ছে ভিতরগড়ের অমূল্য প্রত্নসম্পদ। স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, ভিতরগড়ে ছিল পৃথু রাজার রাজধানী। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে তিনি মহারাজা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ভিতরগড়ে মহারাজার বাড়ি, কাচারি ঘর, দিঘি ইত্যাদি আজও মহারাজার নামের স্মৃতি বহন করছে।
ভিতরগড় পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এর মাটির নিচে লুকিয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস, অসংখ্য স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ ও প্রত্নবস্তু। মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসছে সেসব।
২০০৮ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুসনে জাহান নিজ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভিতরগড়ে গবেষণা ও খননকাজ শুরু করেন। কয়েক দফা খননে বেরিয়ে আসে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসহ ছয়টি প্রাচীন স্থাপনা। গত বছর আরো দুটি মন্দিরসদৃশ স্থাপনার সন্ধান পান ইউল্যাবের গবেষকরা।
ধারণা করা হচ্ছে, এসব স্থাপনা অষ্টম শতকে ভারতীয় বাস্তুশাস্ত্র অনুসরণ করে নির্মিত। এযাবৎ আবিষ্কৃত আটটি স্থাপনার ভিত্তি কাঠামো থেকে লাল ও ধূসর রঙের নকশাখচিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, লোহা ও তামার তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রের মধ্যে আছে থালা, বাটি, হাঁড়ি ও মাটির প্রদীপ। খননের পর স্থাপনাগুলো আবার প্রত্নতাত্ত্বিক কায়দায় মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানান, চারটি আবেষ্টনী দেয়াল দিয়ে পরিবেষ্টিত ভিতরগড় দুর্গনগরী বাংলাদেশে অদ্বিতীয়। এখানে স্তম্ভবিশিষ্ট বারান্দাসংবলিত স্থাপনাটি বাংলাদেশে আবিষ্কৃত এ ধরনের একমাত্র স্থাপত্যিক নিদর্শন। ভিতরগড়ে আছে চাষাবাদের জন্য সেচব্যবস্থা ও নদীর পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাথরের বাঁধ নির্মাণের অনন্য উদাহরণ। মহারাজার দিঘির ইট বাঁধানো দশটি ঘাট ও ঘাটের উভয় পাশে ইট ও মাটি দিয়ে নির্মিত সুউচ্চ পাড় অসাধারণ নিদর্শন।
স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, পৃথু রাজা কীচক নামে অসাধু এবং নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠী দ্বারা আক্রান্ত হলে নিজ পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষার্থে পরিবার-পরিজনসহ দিঘির জলে আত্মহত্যা করেন। ফলে পৃথু রাজার রাজত্বের অবসান ঘটে। ভিতরগড় দুর্গনগরীর বাইরের আবেষ্টনীর উত্তরাংশ, উত্তর-পশ্চিমাংশ এবং উত্তর-পূর্বাংশ বর্তমানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত হওয়ায় ধারণা করা হয়, ষষ্ঠ শতকের শেষে কিংবা সপ্তম শতকের শুরুতে ভিতরগড় স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
বাণিজ্য সড়ক ও নদীপথের ওপর অবস্থিত হওয়ায় ভিতরগড় এলাকার অধিবাসীরা সম্ভবত নেপাল, ভুটান, সিকিম, আসাম, কুচবিহার, তিব্বত, চীন, বিহার এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। স্থানীয় অধিবাসী, স্যালিলান টি এস্টেট, এসিআই গোদরেজ পোলট্রি ফার্মসহ কয়েকটি কম্পানির হাত থেকে ভিতরগড়কে রক্ষায় নির্দেশনা চেয়ে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’-এর পক্ষে ২০১১ সালের ১৪ জুন উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন আইনজীবী মঞ্জিল মোরশেদ।
এর পরিপেক্ষিতে ভিতরগড় দুর্গনগরীকে কেন প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা ঘোষণা দেওয়া হবে না মর্মে একটি রুল জারি করেন আদালত। একই সঙ্গে ভিতরগড় প্রত্নসীমার ২৫ বর্গকিলোমিটারজুড়ে সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ওই এলাকায় সব ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের ওপর নজরদারি বাড়াতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু আদালতের আদেশ অমান্য করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে টোকাপাড়া বিজিবি ক্যাম্প, স্যালিলান টি এস্টেটসহ প্রত্নসম্পদ ধ্বংসকারী একাধিক চা-বাগান, মাজার, দোকানপাট ইত্যাদি।
ইতিহাস গবেষক আলী ছায়েদ বলেন, ‘প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়ে গবেষণার জন্য ভিতরগড় দুর্গনগরীতে আছে পর্যাপ্ত উপাদান। প্রতিটি স্থানেই আছে ইতিহাসের ছাপ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রত্নসম্পদ অবহেলা আর উদাসীনতায় হুমকির মুখে পড়েছে। বহু অমূল্য প্রত্নসম্পদ ও স্থাপত্য নিদর্শন স্থানীয় মানুষের হাতে বিলীন হওয়ার পথে। ভিতরগড় প্রত্নসম্পদের বিশাল ভাণ্ডার হলেও সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়নি।’
ইউল্যাবের অধ্যাপক ও ভিতরগড় খননকাজের উদ্যোক্তা ড. শাহনাজ হুসনে জাহান বলেন, ‘অপার সম্ভাবনাময় ভিতরগড় দুর্গনগরী শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ইতিহাস নির্মাণে প্রয়োজনীয় উৎস সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে। পর্যটনশিল্পের জন্য ভিতরগড় হতে পারে বাংলাদেশের প্রত্ন নিদর্শনের এক বিশাল ভাণ্ডার। অথচ ইতিহাস-ঐতিহ্যের এই প্রত্নস্থল বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মানা হচ্ছে না আদালতের নির্দেশ।’
তিনি অবিলম্বে ভিতরগড় এলাকায় যারা শক্ত স্থাপনা তুলছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি ভিতরগড়কে ‘ঐতিহ্য স্থান’ হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান। পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সবে যোগ দিয়েছি। খোঁজখবর নিয়ে আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারব।’ -কালেরকণ্ঠ
এমটিনিউজ/এসবি