পটুয়াখালী থেকে : লোহার শিকলে বাঁধা মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের জীবন। নিখোঁজ রয়েছেন বাবা শাহজাহান। বিধবা বৃদ্ধা নানির হাত ধরে পথে পথে ঘুরে (ভিক্ষা) খেয়ে না খেয়ে চলে জীবন। শিক্ষার প্রতি অদম্য টান আর দুরন্ত শৈশব বাধাগ্রস্ত কঠিন এ বাস্তবতার বেড়াজালে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে অনিশ্চয়তায় বিবর্ণ হয়ে ওঠে রুবিনার শৈশব। তবুও আলোকিত আগামীর আশা ছাড়েনি সে।
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের মেয়ে রুবিনা (৯)। জন্মের এক বছর পর হারিয়ে যান বাবা শাহজাহান। সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি তিনি। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির নিরুদ্দেশের খবরে দুশ্চিন্তায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন মা আসমা আক্তার ডলি।
জীবিকার তাগিদে বৃদ্ধা অসুস্থ নানি আছিয়া বেগমের হাত ধরে ঘুরে বেড়ায় গ্রামের পর গ্রাম। এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে যদি কিছু মেলে তাতেই জ্বলে উনুন। কোনো দিন একবেলা কিংবা দু'বেলা খাবার জুটলেও উপোস করে কাটাতে হয় অনেক সময়। একখণ্ড জমি না থাকায় আশ্রয় মিলেছে একই এলাকার শহীদ রাঢ়ীর বাড়ির উঠোনে। সেখানে তালপাতা আর ছেঁড়া পলিথিনের একটি ঝুপড়ি ঘরে রোদের উত্তাপ, শীতের তীব্রতা আর বৃষ্টির স্পর্শ নিয়ে রুবিনার বসবাস।
যেদিন কেরোসিন কিনতে পারে সেদিন রুবিনার এ ঘর হয় আলোকিত। অন্যথায় পাশের বাড়ির বিদ্যুতের স্বল্প আলো-আঁধারিতে কাটে বেশিরভাগ রাত। সম বয়সীরা খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকলেও দম ফেলার ফুরসত নেই রুবিনার। সকাল হলেই মায়ের হাত ধরে নানিকে নিয়ে ভিক্ষা করতে হয় গ্রামের পর গ্রাম। মায়ের পরিচর্যাসহ ঘরের সব কাজ তাকেই সম্পন্ন করতে হয়।
এরপর অবসর সময় কাটে মায়ের পাশে বসে একাকি লেখাপড়ায়। টুঙ্গিবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রুবিনা স্বপ্ন দেখে লেখাপড়া শিখে একদিন বড় হবে। মায়ের চিকিৎসা করাবে। সুন্দর একটি বাড়ি হবে। পেট ভরে তিনবেলা খাবার খাবে। মা আর নানিকে নিয়ে সে ঘরে কাটাবে সুখের দিন।
রুবিনা জানায়, 'যেদিন ভিক্ষা করতে যায় সেদিন স্কুলে যাওয়া হয় না। আবার যেদিন স্কুলে যায় সেদিন ভিক্ষা করা হয় না। মায়ের জন্য খুব দুশ্চিন্তায় স্কুলের পাঠে ঠিকমতো মন দেয়াও যায় না।' জমির মালিক শহীদ রাঢ়ী আশ্রয় ছেড়ে চলে যেতে বলায় মানসিক ভারসাম্যহীন দুই বোন, মেয়ে আর শিশু রুবিনার ভবিষ্যৎ চিন্তায় পাগলপ্রায় রুবিনার নানি আছিয়া বেগম (৫৫)।
তিনি জানান, 'এখন আর আগের মতো হাঁটতে পারি না। বিভিন্ন রোগ শরীরে বাসা বাঁধছে। প্রতিবেশী-এলাবাসী যা দেয় তাতেই পেট চলে। না পেলে উপোস থাকতে হয়।' অসহায় রুবিনার পুনর্বাসন, ভরণ-পোষণসহ বাধাহীন শিক্ষা অর্জনের নিশ্চয়তার দাবি জানিয়ে প্রতিবেশী হাসান পারভেজ বলেন, রুবিনা হলো পল্লীকবি জসিম উদদীনের আসমানীর নতুন সংস্করণ।
এদের মতো অসহায় পরিবার নীলগঞ্জ ইউনিয়নে নেই। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদুল হক বলেন, ইতোমধ্যে রুবিনার বাড়িতে চাল পাঠানো হয়েছে। দ্রুত তার স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সহায়তার মাধ্যমে রুবিনার নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।