শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০১:১১:০১

মাল্টার জেলা পিরোজপুর !

মাল্টার জেলা পিরোজপুর !

নাসিম আলী, পিরোজপুর: মাল্টার জেলা পিরোজপুর: মাত্র তিন বছরে বদলে গেছে জেলার ফল চাষের চিত্র। পিরোজপুর পেয়েছে নতুন পরিচিতি। পেয়েছে মাল্টার জেলা হিসাবে খ্যাতি, মাল্টা এখন এ জেলার ব্র্যান্ড। বিদেশি এ ফলটির দেশীয় ভোক্তা চাহিদা মেটাতে অতীতে নির্ভর করতে হত আমদানির উপর। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে এ জেলায় উত্পাদিত মাল্টা এখন রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরের খাদ্য সচেতন মানুষের মৌসুমী ফলের চাহিদা পূরণ করছে। ফলের দোকানে বিদেশি ফলের সাথে স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত এ ফলটি বিক্রি হচ্ছে বেশ কদরের সাথে। তাজা, বিষমুক্ত, সুমিষ্ট লেবু জাতীয় এ ফলের কদর বিদেশ থেকে আনা কমলা, মাল্টা, আপেল, আঙ্গুর, নাশপতি, ডালিমের সঙ্গে বেশ পাল্লা দিয়েই বেড়ে চলেছে। ক্রেতা-দোকানীর কাছে আমদানিকৃত হলুদ মাল্টার চেয়ে পিরোজপুরের সবুজ মাল্টার কদর বেশি। দাম বিদেশি অন্যান্য ফলের চেয়ে সস্তা বলে ক্রেতারা এ ফলটির দিকে ঝুঁকছেন। ক্রেতারা ইতিমধ্যে জেনে গেছেন ফলগুলো বাগান থেকে সদ্য তুলে আনা হয়েছে, পচন ঠেকাতে ফরমালিনের স্পর্শ লাগেনি। তাই নিরাপদ ফল জেনেই খাদ্য সচেতন ভোক্তারা দোকানে গিয়ে পিরোজপুরের মাল্টা খোঁজেন।
 
পাঁচ বছর আগেও এ জেলায় স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত ফলের মধ্যে পেয়ারা ও আমড়ার নাম ছিল সর্বাগ্রে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকায় এ ফল দু’টির চাহিদা ছিল ব্যাপক। মাত্র তিন বছরে হাতে গোনা কয়েকজন পথিকৃত্ ফলচাষী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সহায়তা আর প্রশাসনের কল্যাণে মাল্টাকে এ জেলার সম্ভাবনাময় একটি ফল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত করেছেন। জেলার দোয়াশ মাটি যে মাল্টা চাষের উপযোগী তা জানা ছিলো না স্থানীয় কৃষকদের। নারিকেল, সুপারি, কলা, আমড়া ইত্যাদির ব্যাপক আবাদ করেই সন্তুষ্ট থাকতেন তারা কয়েক বছর আগেও। এখানে শখের বশে বছরে ১/২টা মাল্টার বাগান হলেও এখন তা  ৭০০ বাগানে উন্নীত হয়েছে। পিরোজপুরের আগে দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে কিছু কিছু মাল্টা চাষ শুরু হলেও তা ব্যাপকতা পায়নি।
 
পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মো. খায়রুল আলম সেখ জানান, গত দুই বছরে জেলায় মাল্টা চাষে বৈপ্লবিক যে পরিবর্তন এসেছে তার উপরে ভিত্তি করে সরকার জেলার ব্র্যান্ডিং করেছে মাল্টাকে। দেশের মধ্যে পিরোজপুরকে মাল্টা চাষের মডেল হিসাবে গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রায় সাতশ বাগান এ জেলায় গত ২/৩ বছরে গড়ে উঠেছে। কৃষকদের মাঝেও সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। শুধু পিরোজপুর পৌর এলাকার একটি নার্সারিসহ নেছারাবাদের (স্বরূপকাঠি) বিভিন্ন নার্সারি থেকে ১০ লাখেরও বেশি চারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়েছে। আগামীতে দেশে পিরোজপুর মাল্টার জেলা হিসাবে গৌরবময় পরিচিতি অর্জন করবে।
 
পিরোজপুরের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. আবুল হোসেন তালুকদার জানালেন,  জেলার একটি কৃষি প্রকল্পের মাধ্যমে মাল্টা চাষকে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে।  ২০০৭-২০০৮ সালে এ জেলায় মাত্র একটি মাল্টা বাগান ছিল যা এখন ৬৭০টি। শুধুমাত্র সদর উপজেলায় চাষিরা ২১২টি মাল্টা বাগান সৃজন করেছেন। এছাড়া নেছারাবাদে ১৭০, নাজিরপুরে ১২০, মঠবাড়িয়ায় ৫৪, কাউখালীতে ৫০, ভান্ডারিয়ায় ৩৮ এবং ইন্দুরকানিতে ২৬টি বাগান রয়েছে। জেলার ৬৭ হেক্টর জমি মাল্টা চাষের আওতায়। এসব বাগানে প্রায় ৭৫ হাজার মাল্টা চারা রয়েছে। এসব চারা এই জেলারই নেছারাবাদ উপজেলার বিভিন্ন নার্সারি থেকে সংগৃহীত। নেছারাবাদের নার্সারি চাষিরা অনেক দিন ধরে অন্যান্য ফুল-ফলের সাথে মাল্টার চারাও উত্পাদন করে আসছেন।
 
পিরোজপুর-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাট সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে পিরোজপুর জেলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিনামূল্যে এবং স্বল্পমূল্যে মাল্টার চারা সরবরাহ করে প্রদর্শনী প্লট করে প্রথমে পিরোজপুর সদর উপজেলায় ২০১৪ সালে মাল্টা চাষ জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যা পরে জেলায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, বাণিজ্যিকভাবে অনেক উদ্যোক্তা মাল্টা চাষের প্রতি আগ্রহ দেখানোয় ২০ হেক্টর আয়তনের একক বাগানও করা হয়েছে।    
 
পিরোজপুরে মাল্টা চাষের পথিকৃত্ হচ্ছেন সদর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের অমলেশ রায়। স্নাতক পাশ পঞ্চাশোর্ধ্ব অমলেশ বর্তমানে গৃহশিক্ষকতার ফাঁকে সময় কাটান  নিজের করা ফলের বাগানে।  গ্রামে বাপ-দাদার ভিটায় চার একর জমিতে সৃষ্ট উঁচু বাগানে বিভিন্ন ফলের চাষ শুরু করেন বছর দশেক আগে। ভারত, পাকিস্তান ও থাইল্যান্ড জাতের তিন প্রজাতির মাল্টা গাছ রয়েছে তার বাগানে, যা তিনি পাশের স্বরূপকাঠির আব্দুল জলিলের নার্সারি থেকে কিনেছেন। শখের বশে শুরু করলেও ঝুঁকি আর ঐকান্তিকতা নিয়ে  ব্যয়কৃত অর্থ-শ্রম-মেধার বিনিময়ে  তা আজ তাকে দিয়েছে তৃপ্তি, খ্যাতি আর সচ্ছলতা।
 
ফলের বাগান করার আগ্রহ কেমন করে এলো জানতে চাইলে অমলেশ রায় জানান, গ্রামের ছেলে হওয়ায় পূর্বপুরুষের ধানের ক্ষেতে প্রথমে সবজির বাগান শুরু করেছিলেন লেখাপড়ার পাশাপাশি। এক পর্যায়ে তার মাথায় ফলের বাগান করার চিন্তা আসে মামাতো ভাই কলেজ শিক্ষক শ্যামল মন্ডলের অনুপ্রেরণায়। ধান চাষের পাশাপাশি ফলের বাগান তৈরিতে নেমে পড়েন অমলেশ। তিন বছর আগে তার বাগানে মাল্টা ফলতে শুরু করে। তারপর আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। মাল্টা চাষ অমলেশকে এখন ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছে। কৃষিবিদ, কৃষক, মিডিয়াকর্মী, সাধারণ উত্সাহী মানুষ অনেকেই তার বাগান দেখতে ভিড় জমান ফলন মৌসুমে। অমলেশ রায়ের বাগানে মৌসুমে দেখা মেলে থোকায় থোকায় শত শত সবুজ আর হলুদ বর্ণের মাল্টা।
 
পাশের গ্রাম ডাকাতিয়ার রেবতী সিকদারও একজন সফল মাল্টা চাষি। অমলেশের বাগান দেখে ছয় বছর আগে রেবতীর নিজ বাড়িতে ১০ শতাংশ জমিতে ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে মাল্টা চাষ শুরু করেন। মাধ্যমিক পাস রেবতী এ বিনিয়োগের পুঁজি সংগ্রহ করেছিলেন স্ত্রীর গলার হার বিক্রি করে। বর্তমানে তার পুঁজি ১০ লাখ টাকা। এ সময় ঘর মেরামতসহ সাংসারিক খরচ মেটানোর পরও তিনি অর্থ জমিয়ে স্বরূপকাঠির ছৈলাবুনিয়া গ্রামে সাড়ে তিন একর জমি ভাড়ায় নিয়ে একটি বড় মাল্টা বাগান স্থাপনের কাজে ব্যাপৃত হয়েছেন। গেল মৌসুমে তিনি এক লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করেছেন।
 
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে পিরোজপুরের মাল্টা চাষিরা বিভিন্ন সময় পরামর্শ, প্রশিক্ষণ, সার, গাছের চারা ইত্যাদি সহায়তা পেয়ে আসছেন। রেবতী সিকদার জানালেন,  স্থানীয় বাজারে মৌসুমে মাল্টার চাহিদা বেশ। রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের শহরগুলোতে তাদের বাগানের মাল্টা বাজারজাত করেন। এমনকি মোবাইল ফোনে অর্ডার দিয়ে, বিকাশে টাকা পাঠিয়ে শহরের ক্রেতারা তার কাছ থেকে মাল্টা কেনেন। যা তিনি কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠিয়ে দেন। স্থানীয় বাজারে ১২০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি হয়। পিরোজপু্র ও স্বরূপকাঠি থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হাজার হাজার মাল্টা চারা সরবরাহ করা হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের বগুড়া, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঈশ্বরদী প্রভৃতি এলাকাসহ সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের চাষিরা এ চারা নিয়ে বড় বড় মাল্টা বাগান স্থাপন করছেন।
 
জেলার বিশিষ্ট কৃষি লেখক জগত্ প্রিয় দাস বিশু জানালেন, মাল্টায় প্রচুর পুষ্টিমান ও ঔষধিগুণ রয়েছে। মাল্টা ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ খাওয়া প্রয়োজন। মাল্টার প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যোপযোগী অংশে বিদ্যমান পুষ্টিমানের মধ্যে ভিটামিন ‘সি’ ৪৫ থেকে ৬১ মিলিগ্রাম। এ ছাড়া পানি, আমিষ, চর্বি, শর্করা, আঁশ, ভিটামিন ‘এ’, সাইট্রিক এসিড, খাদ্য শক্তির পরিমাণও সন্তোষজনক মাত্রায় বিদ্যমান। পিরোজপুরের মাল্টার মিষ্টতার মান ১১, যা লেবু জাতীয় ফলের মধ্যে উচ্চমানের।
 
প্রসঙ্গত, মাল্টা লেবু জাতীয় জনপ্রিয় মিষ্টি ফল। এ ফলটির ইংরেজি নাম ‘সুইট অরেঞ্জ’ এবং বৈজ্ঞানিক নাম ‘সাইট্রাস সিনেসিস’। বিশ্বে উত্পাদিত লেবু জাতীয় ফলের দুই-তৃতীয়াংশ হচ্ছে মাল্টা। ব্রাজিল ও আমেরিকায় মাল্টার ফলন হয় বেশি। আমাদের দেশে সাধারণত ফাল্গুন মাসে ফুল আসার পর প্রায় পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হয় পরিপক্ব ফল তোলার জন্য।-ইত্তেফাক
 এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে