মঙ্গলবার, ২১ জুন, ২০১৬, ০৪:২১:০৪

স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী মিষ্টির দোকানে

স্বামীর মৃত্যুর পর  স্ত্রী মিষ্টির দোকানে

পিরোজপুর:স্বামীর মৃত্যুর পর ভেঙে পড়ার কথাই ছিল লিপিকা দেবনাথের। কিন্তু দুটি শিশুসন্তান নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। স্বামী রঞ্জন দেবনাথের মৃত্যুর দুই দিন পর লিপিকা স্বামীর রেখে যাওয়া মিষ্টির দোকানের হাল ধরেন। অভিজ্ঞতা ছাড়াই দুই বছর ধরে নিজে চালাচ্ছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এখন সংসার আর ব্যবসা দুটোই সামলাচ্ছেন তিনি।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালী বাজারে লিপিকা দেবনাথের মিষ্টির দোকান। আমাদের সমাজে একজন বিধবা নারীর পক্ষে এ ধরনের ব্যবসা করতে হলে মানসিক শক্তি প্রয়োজন। আর তা লিপিকাকে দেখলেই বোঝা যায়। উচ্চশিক্ষিত লিপিকা দেবনাথ চাইলেই চাকরি করতে পারতেন। কিন্তু চাকরির পেছনে না ছুটে তিনি হয়েছেন একজন উদ্যোক্তা। তাঁর দোকানে ছয়জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
গত ২৩ মে সকালে মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালী বাজারে লিপিকা দেবনাথের সাতক্ষীরা ঘোষ ডেয়ারি মিষ্টির দোকানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। লিপিকার বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার উত্তর দীঘলদি গ্রামে। ভোলা সরকারি কলেজ থেকে বিএ এবং বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি করেছেন। ২০০৪ সালে যোগ দেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। চাকরির সুবাদে চলে আসেন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায়। ২০০৬ সালে পরিচয় হয় তুষখালী বাজারের মিষ্টি ব্যবসায়ী রঞ্জন দেবনাথের সঙ্গে। প্রথমে ভালো লাগা এরপর দুই পরিবারের সম্মতিতে তাঁরা বিয়ে করেন। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেন লিপিকা। দেড় বছর পর প্রথম সন্তান তন্ময় দেবনাথের (৮) জন্ম। চার বছর পর লিপিকার কোলজুড়ে আসে আরও এক সন্তান (তীর্থ দেবনাথ-৪ বছর)।

স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে সুখে চলছিল দিনগুলো। ২০১৪ সালের ২৫ এপ্রিল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে রঞ্জন দেবনাথ মারা যান। রঞ্জনের মৃত্যুর পর ব্যবসা দেখভালের মতো কেউ ছিলেন না। শ্বশুর নেই। একমাত্র দেবর আলাদা ব্যবসা করেন। মিষ্টির দোকান চালানোর কোনো অভিজ্ঞতাও ছিল না। বাধ্য হয়ে স্বামীর ব্যবসার দায়িত্ব নেন লিপিকা। সেই থেকে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবসা চালিয়ে আসছেন তিনি। প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে বেলা আড়াইটা আবার বিকেল চারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত দোকানে বসেন তিনি। দোকানের ব্যবস্থাপকের কাজ, মিষ্টি মোড়কজাত করা ও পরিমাপের কাজ তিনি নিজেই করেন। তাঁর দোকানে ছয়জন কর্মচারী ও কারিগর রয়েছেন। স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতি মাসে ছয় হাজার টাকায় ঘর ভাড়া নিয়ে দোকান চালাচ্ছেন।

লিপিকা দেবনাথ বলেন, ‘শুরুতে দ্বিধা ছিল। তবে আমার স্বামী রঞ্জন দেবনাথ সদালাপী ছিলেন। সবাই তাঁকে ভালোবাসতেন। সবাই আমাকে ব্যবসায় আসার ব্যাপারে সাহায্য করেছেন।’

দোকান-ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন ও সংসারের খরচ শেষে প্রতি মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা সঞ্চয় করেন তিনি। দুই সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য ওই টাকা জমাচ্ছেন।

কীভাবে সংসার ও ব্যবসা সামলান একসঙ্গে? লিপিকা দেবনাথ বললেন, ‘শাশুড়ি ছোট দেবরের সঙ্গে থাকেন। ছোট ছেলেকে মায়ের কাছে ভোলায় রেখে এসেছি। বড় ছেলে দিনে শাশুড়ির কাছে আর রাতে আমার কাছে থাকে।’ রান্নাবান্না দোকানের পেছনে রান্নাঘরে করা হয়। কর্মচারীদের নিয়ে তিন বেলা খাবার দোকানেই খেয়ে নেন। দোকানের মালামাল কেনা, মিষ্টান্ন তৈরি—সব কাজ নিজে তদারক করেন।

লিপিকা বলেন, গান করা ও বই পড়া পছন্দ করলেও কাজের ব্যস্ততায় এগুলো করার সুযোগ পান না। এখন দুই সন্তানকে লেখাপড়া করানো আর স্বামীর ব্যবসাকে আগলে ধরে বাকি জীবন পার করতে চান তিনি।

দোকানের কর্মচারীরা বলেন, ‘লিপিকা দেবনাথের মিষ্টি ব্যবহার ও দোকানের সুনামের কারণে ব্যবসা ভালোই চলছে। অন্যান্য দোকানের চেয়ে আমাদের দোকানে বিক্রি বেশি হয়।’ তুষখালী বাজারের ব্যবসায়ী শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘দিদির (লিপিকা) দোকানের মিষ্টি ভালো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ হওয়ায় ওই দোকানে ক্রেতা বেশি।’

তুষখালী আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এইচ এম আকরামুল ইসলাম বলেন, লিপিকা দেবনাথকে দেখে প্রথমে আমরা অবাক হয়েছি। আমাদের সমাজে একজন গ্রামীণ নারীর পক্ষে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা খুব সহজ ছিল না। তবে লিপিকা দেবনাথের অসীম মনোবল ও ধৈর্যশক্তির জন্য তিনি এ ধরনের কাজে সফল হয়েছেন।-প্রথম আলো
২১জুন২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এআর/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে