সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সাতক্ষীরার বহুল আলোচিত সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন ৩১২-এর সদস্য মিসেস রিফাত আমিনের পুত্র রাশেদ সরোয়ার রুমনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি হত্যাচেষ্টা ও চাঁদাবাজির মামলায় আদালতের কাছে মোট ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে পুলিশ।
সাতক্ষীরা জেলা যুবলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা জুলফিকার আলী উজ্বলকে হত্যার চেষ্টা ও শহরের বিনেরপোতায় অবস্থিত পদ্দা হ্যাচারির মালিক ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বুলেটের দায়ের করা চাঁদাবাজির এই পৃথক দুটি মামলায় গতকাল সাতক্ষীরা সদর কোর্টের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিজ্ঞ বিচারক নুরুল ইসলামের কাছে লিখিতভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাতক্ষীরা সদর থানার সাব ইন্সপেক্টর রফিক ও ইমদাদ হোসেন।
আজ রিমান্ড শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে। রবিবার একটি মাইক্রোবাসযোগে সাতক্ষীরা থেকে যশোরের উদ্দেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিশেষ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাব-ইন্সপেক্টর বোরহানুল ইসলাম ও আশরাফুল হকের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে শহরের চৌরঙ্গী মোড়ের জনৈক মিজানুর রহমানের ভাড়া বাড়ি থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এ সময় তার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন সেট উদ্ধার করা হয়।
এদিকে রুমন গ্রেফতারের পর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা গা-ঢাকা দিয়েছেন। রুমনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে এলাকাবাসী। বেরিয়ে আসছে রোমহর্ষক যত কাহিনী। গত ১৯ মার্চ সন্ধ্যায় এমপিপুত্র রুমন পদ্দা হ্যাচারির মালিক মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কাজিরপালা গ্রামের সিরাজুল ইসলাম বুলেটকে মোবাইলে ফোন করে তাদের মুসজিতপুরস্থ বাড়ির পাশে জনৈক আতাউর রহমানের বাসায় তুলে নিয়ে আসেন। সেখানে তাকে আটকিয়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। চাঁদার টাকা না পেয়ে রুমন তার বেল্ট দিয়ে ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলামকে শ্বাসরোধে হত্যার চেষ্টা চালান এবং ব্যাপক মারধর করেন।
এর একপর্যায়ে রুমনের সঙ্গে থাকা তার কলগার্ল টুম্পাকে দিয়ে আপত্তিকর ছবি তুলে ফেসবুকসহ বিভিন্ন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি প্রদান করেন। একপর্যায়ে সিরাজুল ইসলামের ম্যানেজার এসে চেকবই দিলে তিনটি চেক বইয়ের পাতায় ৫ লাখ, ১ লাখ আর ৪ লাখ— মোট ১০ লাখ টাকার অঙ্ক বসিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়ে রাত ৯টার দিকে তাকে ছেড়ে দেন রুমন। এরপর বহু চেষ্টা করে ১৪ আগস্ট এ-সংক্রান্ত সাতক্ষীরা সদর থানায় হত্যাচেষ্টাসহ একটি চাঁদাবাজি মামলা করেন ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম। যার নম্বর ২০। কিন্তু পুলিশ তার মা এমপি মিসেস রিফাত আমিনের প্রভাবে তাকে গ্রেফতার না করায় শহরে রুমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর পর থেকে তার মায়ের আশকারায় বেপরোয়া রুমন একের পর এক অপকর্ম ঘটাতে থাকেন নির্বিঘ্নে।
পুলিশ বলছে, রুমনের বন্ধু মাগুরার মিলন পালের সঙ্গে রুমনের সোনা চোরাচালানের সম্পৃক্ততা আছে কিনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এমনকি রুমনের কাছে তার মায়ের ব্যবহূত জাতীয় সংসদের স্টিকার লাগানো গাড়িটি চোরাচালানের কাজে রুমন ব্যবহার করতেন কিনা সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দেখছে পুলিশ। ২ সেপ্টেম্বর ভারতে পাচারকালে সাতক্ষীরার তলুইগাছা সীমান্ত থেকে ১৬ কেজি ৩১৬ গ্রাম সোনাসহ কেড়াগাছি গ্রামের সফিকুল ইসলামের ছেলে আলিউজ্জামান নামে এক চোরাকারবারিকে আটক করে বিজিবি।
এ ঘটনায় থানায় মামলা হলে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে ওই ১৬ কেজি সোনার মূল মালিক সাতক্ষীরার এমপি সিসেস রিফাত আমিনের ছেলে রুমনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাতক্ষীরার মাগুরা গ্রামের মিলন পাল। পরে পুলিশ মিলন পালকে গ্রেফতার করলে তাকে ছাড়িয়ে নিতে দফায় দফায় থানা পুলিশে তদবির করেন রুমন। এমনকি তার মা এমপি রিফাত আমিনকে দিয়েও পুলিশের কাছে ফোন করান রুমন।
মিলন পালের পরিবারের দাবি, এর জন্য মিলনকে খেসারত দিতে হয়েছে ২০ লাখ টাকা। কিন্তু এতেও ক্ষান্ত হননি রুমন। ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা পৌরসভা চত্বরে জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য জুলফিকার রহমান উজ্জ্বলকে লোহার রড ও হাতুড়ি দিয়ে মারধর করেন রুমন ও তার সহযোগীরা। অভিযোগ ছিল সাতক্ষীরা এলজিইডির টেন্ডার আয়ত্তে নিয়ে অর্জিত মোটা অঙ্কের কয়েক লাখ টাকার ভাগাভাগিতে অসন্তোষের জেরে এই মারধরের ঘটনা ঘটে।
হামলার সময় ঠেকাতে গিয়ে আহত হন উজ্জ্বলের সহযোগী মিলন, কালাম, ফারুক, সালামসহ কয়েকজন। তাদের সাতক্ষীরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার পরদিন সাতক্ষীরা সদর থানায় মামলা হলেও পুলিশ রুমন ও তার সহযোগীকে গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়।
এদিকে মঙ্গলবার ঈদের দিন রুমন তার এক বন্ধুকে সাতক্ষীরা কারাফটকে পাঠান আটক মিলন পালের কাছ থেকে ২৫০ টাকার সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষরের জন্য। কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে তা ব্যাহত হয়। কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জানতে পেরে সাদা স্ট্যাম্পগুলো জব্দ করে। রুমন সাতক্ষীরার সোনা চোরাকারবারি মিলন পালের পক্ষে গত রমজানে সাহেব আলী নামের এক গরু ব্যবসায়ীকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে জখম করেন। এর কিছুদিন আগে তার মায়ের ব্যবহূত জাতীয় সংসদের স্টিকারযুক্ত গাড়িসহ শ্যামনগরের বর্ষা রিসোর্টের ১০৪ নম্বর রুমে একই সঙ্গে তিন তরুণীকে নিয়ে অসামাজিক কাজে লিপ্ত থাকা অবস্থায় শ্যামনগর থানার এএসআই লিটন সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন।
পুলিশ ওই সময় ওই রুম থেকে এমপির ব্যবহূত আগ্নেয়াস্ত্র ও ২০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে। জব্দ করা হয় জাতীয় সংসদের স্টিকারযুক্ত গাড়িটিও। সেখানে দলীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুলিশকে ধমকিয়ে চাপ সৃষ্টির পর নামমাত্র মোটরযান আইনের একটি মামলা দিয়ে পুলিশ তাকে জেলহাজতে পাঠায়। এরপর কিছুদিন জেল খেটে সম্প্রতি মুক্তির পর ফের শুরু করেছেন নানান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে টেন্ডারবাজি। বিগত ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার মধ্যে সংবাদপত্র বন্ধের কয়েক দিন এমপিপুত্র রুমনের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডগুলো অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি