গাজী আব্দুল হাজিফ, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: ধ্বংসের পথে সম্ভাবনাময় সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার টালি শিল্প। সহজ শর্তে ব্যাংক ঋন না পাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টিতে সরকারের সহযোগিতার অভাব। আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার না হওয়া ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়াসহ নানা সমস্যার কারণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভবনাময় এ শিল্প পৌছে গেছে ধ্বংসের দ্বারে। কলারোয়া উপজেলার মুরারিকাটি ও শ্রীপতিপুর গ্রামে অর্ধ শতাধিক টালি কারখানার অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। টালি শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় ৪ হাজার শ্রমিক মানবেতর জীবন যাপন করছে। ৪১টি কারখানার মধ্যে সচল আছে মাত্র ১৫টি।
কলারোয়া টালি কারখানার মালিক ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি ও কলারোয়া ক্লে টাইলস-এর মালিক গোষ্ট চন্দ্র পাল বলেন, পূর্বপুরুষদের পেশা ছিলো প্রতিমা তৈরি করা। মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরি করে হাত পাকিয়েছেন এখানকার পালরা। প্রতিমা তৈরী করে মুরারিকাটি ও শ্রীপতিপুর এলাকার পালরা সারা দেশে খ্যাতি অর্জন করেন। শুধু তাই নয়, পালপাড়া বধ্যভূমির কারণে এখানকার ঐতিহ্য রয়েছে। ২০০০ সালের দিকে এখানে টালি নির্মাণ শুরু হয়। ২০০২ সালের দিকে ইটালীয় ব্যবসায়ী রাফাইলো আলদো অসেন বাংলাদেশে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তিনি নারায়নগঞ্জে টালি তৈরীর কাজ শুরু করেন। কিন্তু এ এলাকার টালি তৈরি উপযুক্ত না হওয়ায় তিনি তার দেশে ফিরে যান। রাফাইলো আলদো ফিরে গেলেও কোম্পানির ম্যানেজার রুহুল আমিন দেশের বিভিন্ন স্থানে পোড়া মাটির টালি তৈরির জন্য মাটি খুজতে থাকেন। কলারোয়ার কুমোরপাড়ায় এসে পেয়ে গেলেন মাটির ঠিকানা। কারার এক্সপোর্ট ইমপোর্ট প্রা. লি.-এর মালিক রুহুল আমিন কলারোয়া কুমোরদের পোড়া মাটির তৈরী টালির সম্ভাবনার পথ দেখান। সেই সুচনা। এরপর শুরু হলো টালি তৈরি। শুরুতেই ৫টি টালি কারখানার উৎপাদিত টালি ইতালিতে রপ্তানি হতো। এ কারণে এলাকাকে অনেকেই ইতালিনগর বলে থাকেন। দু’বছর যেতে না যেতেই এখানকার উৎপাদিত টালি নজর কাড়ে জার্মান, দুবাই, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের। দেশের মাটি পৌছে যায় ইউরোপ-আমেরিকায়। বিনিময়ে আসতে থাকে বিদেশি ডলার। জাহাজে করে রপ্তানি শুরু হয় এখানকার টালি। মংলা বন্দর দিয়ে কলারোয়া মাটির তৈরী টালি চলে যায় ইউরোপে। বিনিময়ে আসে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা। চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে এখানকার টালি কারখানার সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এসব কারখানার কাজ পায় প্রায় ৪ হাজার শ্রমিক।
২০১০ সাল পর্যন্ত টালি শিল্প মালিকদের সুদিন ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ ভালোই দাম পেয়েছেন তারা। প্রতিটি টালি ৩০ থেকে ৬০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এতে করে প্রতি বছর এ শিল্প থেকে ৩০০ কোটিরও অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো। ২০১০ সালের পর থেকে এ শিল্পে ভাটা পড়ে।
গোষ্ট চন্দ্র পাল আরো বলেন, এক কন্টেইনার সমান ১৫ হাজার পিস টালি। প্রতি মাসে ৩০ কন্টেইনার টালি যেতো ইটালিতে।
বর্তমানে ৫/৬ কন্টেইনার টালি যায় ইতালিতে। তিনি আরো বলেন, সমিতির অনেকেই টালি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমানে মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ ইমাদুল ইসলাম সদস্য আব্দুর রব মোল্যা, শ্রীকান্ত পাল, তৈলাজ পাল, মদন পাল, শংকর পাল ও সন্তোষ পালসহ ১৫/১৬ কারখানা চালু থাকলে উৎপাদন খুবই কম। কারখানা বন্ধ করেছেন লহ্মনপাল, ময়না পাল, জগবন্ধু পাল স্বপন পাল, মোসলেম উদ্দীন ও পরিতোষ দাসসহ ২৫/২৬ জন।
তিনি আরো বলেন, প্রতিটি স্কয়ার টাইল ২ থেকে ১০০ টাকা রেকট্যাংগুলোর টাইলস ৩ থেকে ৬০ টাকা, স্টেপ টাইলস ১০ থেকে ৩৫ টাকা, বেন টাইলস ১৫ থেকে ২৫ টাকা, টেরাকেটা টাইলস ৬ থেকে ৩০ টাকা, লিস্ট টাইলস ৩ থেকে ১০ টাকা দরে বিক্রি হয়।১০/১২ ফ্যাশনের টাইলস তৈরি হয় এখানে, তৈরি টাইল্স ঘরের মেঝে, দেয়াল, ছাদ সাজানোসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়।
টালি কারখানা মালিক সমিতির অন্যান্য সদস্যরা জানান, প্রতি বছর নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হয় টালি মৌসুম। ৩১ মে পর্যন্ত চলে উৎপাদন।
প্রতি মৌসুমে সর্বোচ্চ ৩০ বার পন (চুল্লি) জ্বালানো যায়। প্রতি পনে ছোট আকারে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টালি এবং বড় আকারের ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টালি উৎপাদন করা যায়। প্রতি পনে খরচ হয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করার পর লাভের মুখ দেখা যায় বলে জানান টালি কারখানার মালিকরা।
মালিকরা জানান, এ শিল্পের সাথে জড়িত রয়েছে প্রায় ৪ হাজার শ্রমিক। শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রতি কন্টেইনার টালির উৎপাদন খরচ প্রায় এক লক্ষ টাকা। ইউরোপের বাজারে যার মূল্য দেড় থেকে দু লক্ষ টাকা। বছরে প্রায় ৪০০ কন্টেইনার টালি রপ্তানি করে শতশত কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায়ী ও মালিকদের অসম প্রতিযোগিতার কারণে এ শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারে পৌছে গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, একদিন এ শিল্পের সুদিন ছিলো। আজ দুর্দিন। ব্যবসায়ীরা সুদিন ফিরিয়ে আনতে সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও সুষ্ঠুনীতি মালার দাবি জানান।
১৪ মে ২০১৬/ এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস