মঙ্গলবার, ১৭ মে, ২০১৬, ১২:০০:৩০

সুইসাইড নোটে অর্ণব, কেঁদো না আর আম্মু, আমাকে মাফ করে দিও’

সুইসাইড নোটে অর্ণব, কেঁদো না আর আম্মু, আমাকে মাফ করে দিও’

সাতক্ষীরা : সুইসাইড নোটে অর্ণবের হৃদয়ছোঁয় বাণী, পড়লে যে কাউকে কাঁদাবে।  সাতক্ষীরা সদরের রাজার বাগান এলাকার ব্যাংকার জিল্লুর রহমানের ছেলে মেধাবী ছাত্র সাদিদ ফারজিন অর্ণব।  

মে মাসের ৯ তারিখে আত্মহত্যা করে সে।  ১৩ তারিখ এসএসসি পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর জানতে পারা যায়, জিপিএ-৫ পেয়েছে এই কিশোর।

এমন মুহূর্তে পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজনের চোখে ঝরছে জল।  আগের বহু সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এবারো অর্ণবের জিপিএ-৫ পাওয়া আনন্দের বন্যা বইয়ে দিতে পারতো।  কিন্তু এ ফল আরো বেশি কষ্টের এখন।

অর্ণব কবিতা লিখতো, পড়তো প্রচুর বই।  তার বিষণ্নতার নমুনায় তার ছাপ আছে বাড়ির দেয়ালে।
দেয়ালে কবি জসীম উদ্দীনের কবিতার একটি লাইন অনুসরণে— ‘আঁধারের সাথে যুঝিয়া আমার ফুরায়ে আসিছে তেল।  মৃত্যুর আগে দেয়ালে নিজেকে শেষ করে দেয়ার ঘোষণাটি লিখেছে।  I Quit!

দেয়ালের লেখাগুলো দেখে ডুকরে কাঁদছেন অর্ণবের মা-বাবা, তার ছোট ভাইটি।  অর্ণবের ডায়রির পাতাগুলো যেন কথা বলছে।  

সম্মানজনক সরকারি বৃত্তি পাওয়া ও অনেক পুরস্কারজয়ী মেধাবী অর্ণব শেষদিকে সারাদিন ঘর থেকে আর বের হতো না।  সারাদিন পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকতো।  গভীর রাত পর্যন্ত জেগে সকাল ১০টায় উঠতো ঘুম থেকে।

মৃত্যুর আগে সে ডায়রিতে মৃত্যুর কারণ লিখে গেছে। সেইসঙ্গে মে মাসের ৩ তারিখে লেখা ছয় পৃষ্ঠার একটি চিঠিতেও আছে অনেক তথ্য।

ডায়রি ও তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন এখন রয়েছে পুলিশের হাতে।  তেমনটাই জানিয়েছেন সাতক্ষীরা সদর থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) নজরুল ইসলাম।

ছয় পৃষ্ঠার চিঠিতে কী লিখেছে অর্ণব?

লিখেছে, ‘I am sorry! শেষ পর্যন্ত আমাকে সত্যিই এই ডিসিশন নিতে হল। ডিপ্রেশন আমাকে জীবন্ত লাশই বানিয়ে রেখেছে। এভাবে আর পারছি না। আমি আমার মৃত্যুর কারণ লিখে যাচ্ছি। যদিও আমার ডায়রি যেটা এখন ‘ক’-এর (একটি মেয়েটির নাম) কাছে। ওটা থেকে আমার মৃত্যুর কারণ আরও স্পষ্ট হবে।’

‘আব্বু, তুমি অফিসে যাওয়ার আগে সব সময় আমার ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে বলে যাও না। কিন্তু আজ তুমি বলে গেলে। Thank you আব্বু। তুমি কেঁদো না...’

‘আম্মু, মাফ করে দিও আমাকে। তোমাদের স্বপ্ন ভেঙে চলে যাচ্ছি, আমার নিজেরই কোনও স্বপ্ন বেঁচে নেই।... আর আমার মা-টা যখন কাঁদে খুব কষ্ট হয় আমার। কেঁদো না আর আম্মু! হয়তো দেখা হবে আবার।’

‘আবির (ছোট ভাই), তোর ড্রয়ার থেকে ২০০ টাকা চুরি করেছি। দিতে পারব না।... আম্মুর সাথে ঝগড়া করবি না। খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। অন্য কোনও ইচ্ছা হলে আম্মুকে বলবি। একা একা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে গেলে কিন্তু আমার মত ফাঁসবি।.... আর শোন! নতুন বছরের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজবি। বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয় না। ... প্রথম বৃষ্টিতে ভিজে গোসল করলে সব পাপমুক্তি হয়। এটা তোর ভাই এর থিওরি।’

রাহুল নামের একজনকে ভাইয়া সম্বোধন করে অর্ণব লিখেছে, ‘আমি জানি ছয় ছয় বার কেন আপনি আমাকে মেরেছেন। আপনার জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো এটাই করতাম। কিন্তু একবারও কি ভেবেছেন এত মানুষের সামনে মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে?’

চিঠি পড়ে জানা যায়, ২০১৩ সাল থেকে একটি মেয়েকে ভালোবেসে এসেছে অর্ণব। কিছুদিন বেশ ভালো সময় কেটেছে ওদের।  এরপর বিভিন্ন কারণে তাদের দূরত্ব তৈরি হয়।  সম্প্রতি মেয়েটির ওপর নজর দেয়া আরেক কিশোর পনের বিশজনের দল নিয়ে অর্ণবের ওপর ছয়বার চড়াও হয়।  অর্ণব তখন রোজা রেখেছিল।

জানা যায়, শেষবার ছেলেগুলোর মারধরে অর্ণবের কান কেটে রক্ত পড়তে থাকে।  ওর পরিচিত সমাজে এবং ওর পরিবারকে ছোট হতে হয়।  এসব ঘটনায় অর্ণবের আত্মসম্মানবোধ ভীষণ আঘাতগ্রস্ত হয়।  এ সময় বন্ধু ও স্বজনদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকে অর্ণব।  অভিমানী এ কিশোর যে ধীরে আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছে তা কেউ বুঝতে পারেনি।

অর্সবের মা মেহেরুন্নেছা বলেন, অর্ণব ছিল আশার বাতিঘর।  ওই বাতিঘরে অন্ধকার নেমে এসেছে।  ওর এসএসসির ‘এ প্লাস’ আমাদের কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

এএসআই নজরুল ইসলাম জানান, অর্ণবের মৃত্যুকে ঘিরে কোনো মামলা এখন পর্যন্ত হয়নি।  পরিবার ময়নাতদন্তে রাজি হয়নি।  মামলা হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
১৬ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এমআর/এসএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে