জুবায়েল হোসেন, চৌহালী (সিরাজগঞ্জ): যমুনাবিধৌত সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ১৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে হাই স্কুলে যেতে হয়। ইউনিয়নজুড়ে একটি পূর্ণাঙ্গ হাই স্কুল না থাকায় মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসার ব্যাহত হচ্ছে। অনেকে ৮ম শ্রেণির উপরে লেখাপড়া করতে পারছে না।
দুর্গম এ ১৮ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে নৌপথ, সড়কপথ, বালিময় হাঁটাপথ। এ পথ পাড়ি দিতে প্রতিদিন কৃষক পরিবারের সস্তানদের গুনতে হয় অন্তত ৬০ টাকা। এর মধ্যে যাদের খরচের টাকা ব্যয়ের সামর্থ না থাকে তারা ৮ম শ্রেণির উপরে আর পাঠদান না করতে পেরে ঝরে পড়ে। এ অবস্থায় গত ৫৪ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বসন্তপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি ৯ম ও দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদানের জন্য পূর্ণাঙ্গ হাই স্কুলের অনুমোদন দেওয়া হলে অন্তত ৩শ ছাত্র-ছাত্রীর দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।
সিরাজগঞ্জের ৯টি উপজেলার মধ্যে ৫টির অবস্থান যমুনার চরাঞ্চলে। এর মধ্যে চৌহালী উপজেলা মুল ভূ-খন্দ যমুনা নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। ১৮৬৪ সালে স্থল পাকড়াশী জমিদারদের প্রচেষ্টায় স্থল পাকড়াশী ইন্সটিটিউশন নামে একটি বিদ্যাপীঠ স্থাপিত হয়েছিল। নদী ভাঙ্গনের কারণে প্রায় ৫৫ বছর আগে এই প্রতিষ্ঠানটিকে পার্শ্ববর্তী শাহজাদপুর উপজেলার রূপসীতে স্থানান্তর করা হয়। এরপর ১৯৬৫ সালে আব্দুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বসন্তপুর চরে একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেটিও দফাফ-দফায় ভাঙ্গনে বিপর্যস্ত হয়ে বর্তমানে ছোট চৌহালীতে অবস্থান করছে।
স্থল ইউনিয়নের মালিপাড়া, নওহাটা, তেঘুরী, হাটবয়রা, নয়াপাড়া, গোসাইবাড়ি, গোয়ালবাড়ি, চালুহারাসহ প্রায় ১৬টি গ্রামের একমাত্র বসন্তপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া শেখানো হয় ছাত্র-ছাত্রীদের। এরপর যারা জেএসসি পাশ করে থাকে, তাদের ৯ম ও দশম শ্রেণিতে পাঠদানে বিপাকে পড়তে হয়। যেতে হয় ৯ কিলোমিটার দূরের এনায়েতপুরের মেহের-উন নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, এনায়েতপুর ইসলামীয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, বেতিল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এতে দুর্ভোগের যেমন সীমা থাকে না, তেমনি করতে হয় অর্থ ব্যয়। বাড়ি থেকে ওইসব স্কুলে ক্লাস করতে ৩/৪ কিলোমিটার বালুপথ পাড়ি দিয়ে হাট বয়ড়া নৌকাঘাটে আসতে হয়। তারপর ১৫ টাকা দিয়ে নৌকায় বিপদ সংকুল যমুনা পাড়ি দিয়েই শেষ নয়। এরপর আরো ২/৩ কিলোমিটার যেতে পৌঁছাতে হয় স্বপ্নের হাইস্কুলে। এতে আরো ১৫ টাকা গুনতে হয়। তাতে যাতায়াতে গড়ে প্রতিদিন ৬০ টাকা হারে টাকা না হলে আর স্কুলে যাওয়া যায় না কোমলমতি শিক্ষার্থীদের। অনেক সময় ঝড়-ঝাপটা, রোধ, বৃষ্টি অতিক্রম করে তাদের লেখা পড়া চালানোয় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
এ ব্যাপারে হাট বয়ড়া চরের বাসিন্দা বেতিল উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির ছাত্রী সোনিয়া খাতুন, এনায়েতপুর ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ শ্রেণির ছাত্র কুড়াগাছা চরের শরীফ হোসেন, নওহাটার ৯ম শ্রেণির আঁখি খাতুন, মেহের-উন-নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ শ্রেণির ছাত্রী গোয়ালবাড়ি গ্রামের সাবেকুন্নাহার জানান, যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশই হোক না কেন তাদের ৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে নিজ-নিজ স্কুলে যেতেই হয়। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই হাটবয়ড়া খেয়া ঘাটের নৌকা ধরতে হয়। আবার সেই সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে হয়। এ অবস্থায় লেখাপাড়া চালানো খুবই কষ্টসাধ্য। যাতায়াতেই সময় ফুরিয়ে যায়। শুধু রাতে পড়ে ভালো রেজাল্ট করা যায় না।
এদিকে গোয়ালবাড়ির নবম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল কাদের, তেঘুরীর দশম শ্রেণির আলামিন হোসেন জানান, তারা দরিদ্র কৃষকের ছেলে প্রতিদিন শুধু যাতায়াতেই আমাদের ৬০ টাকা ব্যয় করে ক্লাশ করতে হয়। ১৮ কিলোমিটার যাতায়াতের চেয়ে বাড়ির পাশের বসন্তপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি যদি পূর্ণাঙ্গ উচ্চ বিদ্যালয় হতো তাহলে এমন দুর্ভোগ পোহাতে যেমন হতো না। তেমনি লেখাপড়া ভালো হতো, খরচও হতো না।
বর্তমানে বসন্তপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে জেএসসি পাশ করা ছোট চৌহালীর খাদিজার পিতা রুহুল আমীন এবং গোয়ালবাড়ির সুজনের পিতা খোকন হোসেন জানান, আমরাতো হত দরিদ্র মানুষ। এভাবে সুদূরে টাকা পয়সা খরচ করিয়ে ছেলে মেয়েদের পড়ানো আমাদের সম্ভব নয়। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
স্থানীয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও বসন্তপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হাতেম আলী মাস্টার, বিদ্যালয়ের প্রধান সাইফ উদ্দিন ইয়াহিয়া, ইউপি সদস্য আলেয়া বেগম এবং সমাজ-সেবক শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন জানান, দেশ যেখানে সামগ্রীক উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের এ এলাকাটা শুধু শিক্ষা ব্যবস্থায় পিছিয়ে আছি। আমাদের অবহেলিত এই চর এলাকার ছাত্র-ছাত্রীরা মাধ্যমিক পাশ পর্যন্ত নিজ এলাকায় থেকে করতে পারছে না। আমরা দীর্ঘ দিন ধরে দাবি করছি বসন্তপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিকে ৯ম ও ১০ শ্রেণিতে পাঠদানের অনুমোদনের। তবে এবার আশা করি প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী আমাদের চরবাসীরা প্রতি সদয় হবেন।
এদিকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে জানিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ শফি উল্লাহ জানান, প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে। শুধু মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন হলে স্থল ইউনিয়নের মানুষের মাধ্যমিক পাঠদানে দুর্ভোগ লাঘব হবে।-কালের কণ্ঠ