সুনামগঞ্জ: বেগম নার্গিসকে কুঁপিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা ‘বদ’ বদরুল আলমের গর্ভধারিনী দিলারা বেগম নিজেই এই বর্বরোচিত হামলার বিচার ও হামলাকারীর সাজা চেয়ে বলেছেন, এই বদরুল আমার সন্তান হতে পারে না। আমি এই ঘটনার বিচার চাই। হামলাকারীর শাস্তি দেখে মরতে চাই।
গতকাল বুবধার সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জে ছাতকের মনিরজ্ঞাতি গ্রামের নিজ বাড়িতে নিজের ছেলের জঘন্য কর্মকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। বদরুলের মা দিলারা বেগম জানান, খাদিজা আক্তার নার্গিসের ওপর হামলার পর গণপিটুনির শিকার হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় তার ছেলেকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার খবর তারা পেয়েছেন। কিন্তু বদরুলের পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে কারণে তারা এতোই লজ্জিত ও বিব্রত যে তাকে হাসপাতালে দেখতে যাননি পরিবারের কোন সদস্য।
বদরুলের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমি অভাবী মানুষ। মানুষের কাছ থেকে সায়-সাহায্য নিয়ে তাকে লেখাপড়া করিয়েছি। বিদেশ থেকে আসার পর তার বাবা অসুখে পড়ে জমি-জমা বিক্রি করে দেন। সংসারে সাবাই তার দিকে তাকিয়ে ছিল। অনেক আশা-ভরসা ছিল তার উপর। কিন্তু এটা কী করলো বদরুল? এটা আমার সন্তান হতে পারে না। আমি হামলার বিচার চাই।
ছয় মাস আগে স্বামী হারিয়েছেন গৃহিনী দিলারা বেগম। চার ছেলে এক মেয়ের মধ্যে বদরুল দ্বিতীয়। পিতার সৌদি আরবের আয়ের টাকায় একটি পাকা বাড়ি বানালেও পরবর্তীতে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেও জায়গাজমি বিক্রি করে দেন। এখন স্থাবর সম্পদ বলতে এই বাড়িটিই। আর কিছু নেই।
বিলাপ করতে করতে বদরুলের মা বলেন, খেয়ে না-খেয়ে অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করিয়েছি। ছেলেমেয়েদের মধ্যে বদরুলই ছিল সবচেয়ে ভালো ছাত্র। তাকে ঘিরে ছিল সবচেয়ে বেশি আশা-ভরসা। অথচ সেই বদরুলই বুকটা ভেঙে দিল। সে এমন একটা জঘন্য কাজ করল, যার জন্য মুখ দেখাতে পারছি না। পরের মেয়েকে এমন জালিমের মতে মারল কীভাবে। সে তো এমন ছিল না।
দিলারা বেগম জানালেন, বদরুলের তিন ভাই এক বোনের মধ্যে কেউই গুরুতর আহত বদরুলকে দেখতে যাননি। যার ভেতরে মানুষের প্রতি মমতা নেই তার জন্য কোনো মায়া তারা দেখাতে চান না। ঘটনার পর থেকে পরিবারের কেউ লজ্জায় ঘর থেকে বের হচ্ছে না। বদরুলের মা আর কোনো কথা বলতে রাজি হলেন না।
দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম মনিরজ্ঞাতিতে একই আঙ্গিনায় আলাদা বাড়িতে বাস করেন বদরুলের চাচা আব্দুল হাই। তিনি জানান, বদরুল খুব ভালো ছাত্র ছিল দক্ষিণ খুরমা মনিরগাতি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বদরুল এসএসসি ও গোবিন্দগঞ্জ কলেজ থেকে এইচএসসিতে খুব রেজাল্ট করে।
এরপর ভর্তি হন শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হন। তার বাবা সৈয়দুর রহমানের খুব বড় স্বপ্ন ছিল বদরুলকে নিয়ে। ছয়মাস আগে তিনি মারা যান।পিতার মৃত্যুর পর টানাপোড়েনের সংসারের হাল ধরে রেখেছেন দর্জি দোকানী বড়ভাই। ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন কৃষিকাজ করে এবং অন্যজন স্কুলে পড়ে।
একমাত্র বোন ছাতকের গোবিন্দগঞ্জ কলেজে স্নাতকের ক্লাসের ছাত্রী। বদরুল নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি ছাতকের গৌবিন্দগঞ্জ আয়েজুর রহমান উচ্চ বিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
বদরুলের কথা বলতে বলতে চাচা আব্দুল হাইয়ের চোখে পানি চলে এলো। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বললেন, ‘আগে তো বদরুইল্লা ভালাই চলতো। কিন্তু তার ভিতরে যে কিতা আমরা জানতাম না। আমরা তারে খাছ দিলে পড়াত দিছলাম। সারা পরিবারের আশা-ভরসা আছিল তার উপরে। আর সে আইজ বংশের ইজ্জত মারলো।এই কুলাঙ্গারের মুখ দেখতাম চাই না। হের কথা আমরাকে আর জিগায়েন না’।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ‘বদ’ বদরুল আলম খাদিজাদের বাসায় লজিং থেকে পড়াশোনা করতো। খাদিজাকেও সে পড়াতো, ওইসময়ই তাকে প্রেম নিবেদেন করে প্রত্যাখ্যাত হয় বদরুল। তারপর সে মেয়েটিকে উত্যক্ত করতো। বিষয়টি খাদিজা তার পরিবারকে জানালে তারা বদরুলকে অপমান করে লজিং থেকে তাড়িয়ে দেন।
এরপর পরই ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের এক সংঘর্ষে ঘটনাচক্রে আহত হয় বদরুল। এজন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে শাবিপ্রবি ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক পদ দিয়ে মুল্যায়ন করা হয়। ছাত্রলীগের পদ পেয়ে সে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করলেই তাকে মারধর করতো।
ক্যাম্পাসে প্রভাবশালী নেতা হয়ে ওঠার পর তার মনে ফের খাদিজাকে পাওয়ার সাধ জাগে। আবার পিছু নেয় সিলেট মহিলা কলেজে ওই ছাত্রীর।কিন্তু খাদিজা বেগম নার্গিসের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সে।
গত সোমবার সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে খাদিজা বেগমকে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে বদ দবদরুল আলম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হামলার ঘটনার ভিডিও ছড়য়ে পড়লে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। খাদিজা বর্তমানে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর সদ্ধিক্ষণে রয়েছেন।-পূর্বপশ্চিম
০৬ অক্টোবর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ