সুনামগঞ্জ: গ্রামবাংলার মানুষের কাছে খুব পরিচিত গরু ও মহিষের গাড়ি। তবে প্রযুক্তি উন্নত হওয়ার সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী এ বাহন। কিন্তু করোনাভাইরাস যেন ঐতিহ্যটি ফিরিয়ে নিয়ে এলো। করোনার কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাওরে বেড়েছে গরু ও মহিষের গাড়ির ব্যবহার।
বর্তমানে সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে চলছে ধান কা'টার উৎসব। কিন্তু কোনো যানবাহন না থাকায় ধান কে'টে বাড়ি নিতে বা খলা থেকে ধান শুকিয়ে বাড়ি নিতে দু'র্ভোগ পোহাতে হচ্ছে কৃষকদের। এ ছাড়া বিভিন্ন জিনিসপত্র বাড়ি নিয়ে আসতে যানবাহন না পাওয়ায় হাওর অঞ্চলের মানুষজন এখন গরু ও মহিষের গাড়িকেই ভরসা হিসেবে দেখছে।
জানা যায়, হাওর প্রধান সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ব্যবহার করছে গরু, মহিষ ও ঘোড়ার গাড়ি। সদর, তাহিরপুর, দিরাই, শাল্লা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দোয়ারাবাজার উপজেলার হাওরের কৃষকদের ধান নেওয়ার জনপ্রিয় বাহন হয়ে উঠেছে গরু ও মহিষের গাড়ি। বিশেষ করে সুনামগঞ্জ সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জের বৃহত্তম ‘দেখার হাওর’র কৃষকদের প্রধান বাহন এখন গরু ও মহিষের গাড়ি। এসব এলাকার কৃষিপণ্য ও নিত্যপণ্য বহনে এখন ব্যাপক ভূমিকা রাখছে এ গাড়ি। নিজের জমির ধান বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘরের গরু ও মহিষকে কাজে লাগাচ্ছেন কৃষকরা।
এ ছাড়া হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকেও মানুষ গরু ও মহিষের গাড়ি নিয়ে আসছেন হাওরে কৃষকের ধান ঘরে তুলে দিতে। যার জন্য তারা পরিবহন খরচ হিসেবে নিচ্ছেন ৩০০-১০০০ টাকা। অন্যদিকে করোনাকালে হঠাৎ করে পুরোনো বাহনের ব্যবহার দেখে অনেকে খুশি হচ্ছেন।
তাদের দাবি, করোনা আমাদের পুরোনো জিনিস করিয়ে দিলো। এদিকে দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া ইউনিয়ন ও রকিনগর ইউনিয়নে প্রায় ১শ মানুষ রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন ঘোড়া নিয়ে। তারা ধানের বিনিময়ে জমি ও খলা থেকে কৃষকের ধান বাড়িতে এনে দেন। এক বিঘা জমির ধান এনে দিলে পারিশ্রমিক হিসেবে নেন এক মণ ধান। তবে দূরত্ব অনুযায়ী পারিশ্রমিক কম-বেশি হয়।
দিরাই উপজেলার বরাম হাওরের কৃষক শফিক আহমেদ বলেন, ‘করোনার লাগিতো গাড়ি নাই। আগে ছোট ট্রাক্টর দিয়া ধান ঘরে নিতাম। এখনতো করোনার লাগি কেউ আসে না। তাই আমি মহিষের গাড়িই শেষ ভরসা পাইছে। এটা আমাদের বাপ-দাদাদের আমলের কথা মনে করিয়ে দের।’
শাল্লা উপজেলার আনন্দপুর এলাকার কৃষক শীভাস দাস বলেন, ‘আমি ধান কাটার জন্য ড্রাম ট্রাক্টর ও মহিষের গাড়ি এবং গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করেছি। সময়ের পরিবর্তনে আমরা আধুনিক হলেও মহামারীতে এগুলো কোনো কাজে লাগছে না। তাই আমাদের এখন আবার পুরোনো স্মৃতিতে চলে যেতে হচ্ছে। ছোটবেলা বইতে পড়েছিলাম গরুর গাড়ির গল্প, আজকে সেটা বাস্তবেও করতে হচ্ছে।’
হবিগঞ্জ থেকে হাওরে কৃষকদের সাহায্য করতে আসা মহিষের গাড়ি চালক সুমন মিয়া বলেন, ‘যেহেতু করোনাভাইরাসের কারণে ধান নিয়ে যেতে কষ্ট হবে, তাই আমরা মহিষের গাড়ি নিয়ে শাল্লায় এসেছি। বিনিময়ে আমরা জায়গা বুঝে ৩শ থেকে ১ হাজার টাকা চাচ্ছি। শুনেছি হাওরে বন্যা হবে। তাই আমাদের কৃষক ভাইদের ধান ঘরে তুলতেই আমাদের এখানে আসা।’
আরেকজন চালক লিটন মিয়া বলেন, ‘যতোটা আশা করে মহিষের গাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। ততোটা হচ্ছে না। কারণ আমাদের মজুরি কম দেওয়া হচ্ছে। একটা মহিষকে খাওয়ানোরও তো খরচ আছে। আবার নিজের পেট এবং পরিবারও তো আমাদের দেখতে হবে। সব মিলিয়ে এসে বেশি একটা লাভবান হই নাই।’
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, ‘আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। কারণ করোনাভাইরাস আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, একসময় যা ছিলো তার কাছে প্রযুক্তিও ব্যর্থ। গরু ও মহিষের গাড়ি নতুন করে হাওরে আসায় আমরা খুব খুশি। নতুন প্রজন্মও এটির সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে পারবে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. সফর উদ্দিন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলায় ৭৩ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। আশা করি কয়েকদিনের মধ্যে শতভাগ ধান কা'টা হয়ে যাবে। কৃষকের গরু ও মহিষের গাড়ি সনাতন পদ্ধতি। এটি আবার ফিরে এসেছে, সেটি খুব খুশির খবর। করোনা আমাদের অনেক কিছুই মনে করিয়ে দিলো।’-জাগো নিউজ