ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে : বিকট শব্দে প্রথম বোমাটি বিস্ফোরিত হয়। মানুষের আর্তনাদ, কান্নার রোল। রক্ত সমেত মানুষ গড়াগড়ি খাচ্ছিল রাস্তায়। কারও হাত উড়ে গেছে। কারও পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। কারও কারও দেহ নিথর-নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে। ঘটনার পরপরই সেখানে ছুটে যান র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ। সঙ্গে ছিলেন পুলিশের ইন্সপেক্টর আবু কাওছার ও মনিরুল ইসলামসহ বোমা ডিসপোজাল টিমের সদস্যরা।
তারা গিয়েই ফিতা টেনে ঘটনাস্থল কর্ডন করে ফেলেন। চারদিকে অন্ধকার। অদূরে আতিয়া ভবনের ভেতর থেকে গুলি ও বোমার শব্দ আসছিল। লোকজনের ঠাসা পুরো এলাকা। বোমার বিস্ফোরণের পর অনেকেই খুঁজে ফিরছিলেন স্বজনদের। নিখোঁজদের সন্ধানে আসা লোকজনকে সামাল দেয়া কষ্টকর ছিল। এরপরও পুলিশের পক্ষ থেকে লোকজনের সরিয়ে নেয়া হয় অনেক দূরে। প্রথমটি বিস্ফোরণের তখনও আধা ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়নি। অন্ধকারে টর্চের আলোয় স্প্লিন্টারসহ আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছিল। ঘটনাস্থলে ছিলেন অনেক কর্মকর্তা।
হঠাৎ এক পুলিশ সদস্যের চোখে পড়ে ঘটনাস্থলে কাছে থাকা দ্বিতীয় বোমাটি। ওই সদস্য ‘বোমা বোমা’ বলে চিৎকার দেন। অসীম সাহসী র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ দৌড়ে যান সবার আগে। সঙ্গে যান বোমা ডিসপোজাল টিমের সদস্যরা। তখন তারা বোমা হাত দেননি। তারা বোমাটিকে দেখছিলেন। অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছিল না। টর্চের আলোতে আবছা আবছা দেখছিলেন। হঠাৎ আরেকটি বিকট শব্দ। বোমার বিস্ফোরণ। নীরব-স্তব্ধ হয়ে যায় এলাকা। একটু পর ফের আর্তনাদ। আর এই বোমায় যারা আহত হলেন সবাই র্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তা। সাহসের সঙ্গে পুরো পরিস্থিতি তারা মোকাবেলা করছিলেন। এতো বড় ট্র্যাজেডির ঘটনা নিকট অতীতেও সিলেটে ঘটেনি।
এতো হতাহতের ঘটনাও ঘটেটি। আর এই বোমার ঘটনাটি ইতিহাসের পাতায় শিববাড়ি ট্র্যাজেডি হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা পুলিশ কর্মকর্তারাও গতকাল ঘটনাকালীন সময়ের বিবরণ দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ ঘটনায় আহত র্যাব ও পুলিশের অন্তত ১৫ জন কর্মকর্তা এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি। ঘটনার স্মৃতি তাদের তাড়া করে ফিরছে। তারা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি এমন ঘটনার সাক্ষী হবে সিলেট।
ঘটনাস্থলেই ফিতার লাইন বরাবর দাঁড়িয়ে ছিলেন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি হারুন উর রশীদ। ভেতরে র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে বোমা ডিসপোজাল টিমের সদস্যরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। ওসি আবু কাওছার ও মনিরুল ইসলাম ছিলেন বোমার খুব কাছাকাছি। আর ওসি হারুন তখন বাইরের মানুষদের দূরে সরাচ্ছিলেন। পুলিশের কেউ কেউ একটু আগে ঘটে যাওয়া বোমা বিস্ফোরণে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। ঘটনাস্থলে ছিলেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার জেদান আল মুছাও। হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণে ফিতার কাছাকাছি থাকা ওসি হারুন লুটে পড়েন মাটিতে। কী ঘটছে অনুমান করতে পারছিলেন না।
কিছু সময় তিনি মাটিতেই পড়ে থাকেন। একটু পর উঠে দাঁড়ান তিনি। দেখেন পা দিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরছে। র্যাব ও পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তারা কাতরাচ্ছেন। কেউ কেউ নীরব হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন। একটুর জন্য রক্ষা পান এডিসি জেদানও। তিনিও স্বাভাবিক হতে পারছিলেন না। দৌড়ে গিয়ে র্যাব ও পুলিশের যারা ঘটনাস্থলে পড়ে আছেন তাদের ধরেন। চিৎকার শুরু করেন গাড়ির জন্য। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা গুরুতর অবস্থায় ঘটনাস্থল থেকে র্যাব ও পুলিশের প্রায় ২০ জন সদস্যকে নিয়ে যান হাসপাতালে। ওসি হারুনকে তোলা হয় গাড়িতে। গুরুতর আহত হয়ে তিনিও হাসপাতালে ভর্তি হন।
তবে- বাঁচানো গেল না সিলেটের চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা আবুল কাওছার ও মনিরুল ইসলামকে। আবুল কাওছার ঘটনার পরপরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। আর ওসি মনিরুলকে হাসপাতালে ভর্তির পরপরই নেয়া হয় আইসিইউতে। কিন্তু ভোরের সূর্য উদয়ের আগেই চিরদিনের জন্য পৃথিবী ছেড়ে বিদায় হয়ে গেলেন তিনি। র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে ওসমানী হাসপাতালেই চিন্তিত হয়ে পড়েন ডাক্তাররা। তার অবস্থা গুরুতর। ওসমানী হাসপাতালের ডাক্তাররা সব চেষ্টাই করেন।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একে মাহবুবুল হক নিজেও ছিলেন সেখানে। সব চেষ্টা চালানো হয়। কোনোভাবেই পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছিল না আজাদের। রাতেই তাকে পাঠানো হয় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। বোমার ঘটনায় গুরুতর আহত লে. কর্নেল আজাদও গতকাল ভোরে পরপারে পাড়ি দিলেন। হাসপাতালে এখনও ভর্তি রয়েছেন র্যাবের তিন কর্মকর্তা। র্যাব কর্মকর্তা মেজর শাহীনও গুরুতর আহত হয়েছেন। শক্তিশালী বোমায় তছনছ করে দিলো সিলেটকে। শোকাহত সিলেটবাসী। শোকাহত সিলেটের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শিববাড়ির ট্র্যাজেডিতে কাঁদছে সবাই। এমজমিন
০১ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসএস