সিলেট থেকে : নগরীর উপশহরের এবিসি পয়েন্টে পুলিশি চেকপোস্ট থেকে অপহৃত হয়নি মৃদুল। নিজেই সোহেলকে ঢেকে এনে মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়। এ সময় মা রওশন ও মামা মুহিবুল তাকে ধরে টানা হেচরা করলেও দমেনি মৃদুল। ভালোবাসার মানুষ সোহেলের মোটরসাইকেলে করে চলে যায়। পরে জনগণকে ভুল বুঝিয়ে ‘তরুণী ছিনতাই’য়ের কথা বলে রাস্তা অবরোধের মতো ঘটনা ঘটান মামা মুহিবুল। পরে লোকজন সত্য জানার পর অবরোধ প্রত্যাহার করেন।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ব্যস্ততম এবিসি পয়েন্টে এ ঘটনা ঘটে। তবে ঘটনার দুই ঘণ্টার মাথায় মধ্যরাতেই পুলিশ তরুণী মৃদুল ও স্বামী সোহেল আরমানকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। এ সময় মৃদুল ও আরমান পুলিশের কাছে স্বামী-স্ত্রী বলে পরিচয় দেয়। তারা পুলিশের কাছে বিয়ের কাবিনও জমা দিয়েছে। মৃদুলের পুরো নাম জান্নাতুল ফেরদৌস মৃদুল। তার বয়স ২১ বছর। বাড়ি সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার রাইকদারা গ্রামে। পিতার নাম আসাব উদ্দিন।
আর সোহেলের পুরো নাম সোহেল আরমান। বয়স ২২ বছর। তার বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। তবে- দীর্ঘদিন পিতা বাবুল মিয়ার সঙ্গে শহরতলীর মিরাপাড়া এলাকায় বসবাস করছে। বাবুল মিয়া পেশায় বরফকল কর্মচারী। মৃদুলের মামার বাড়ি মেজরটিলার ইসলামপুর এলাকায়। মধ্যরাতে পুলিশের কাছে আটকের পর সোহেল ও মৃদুল তার দীর্ঘদিনের প্রেম ও বিয়ের ঘটনা জানিয়েছে। তারা দাবি করেছে- তারা বৈধ স্বামী-স্ত্রী। মৃদুলের পরিবার দীর্ঘদিন ধরে তাদের বিয়ে নিয়ে টালবাহানা করছে।
রাতেও মৃদুল সিলেটের শাহপরাণ থানাতে মা রওশনের সঙ্গে পুলিশের সামনে এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা করেছে। এ সময় মৃদুল বলেছে তাকে সোহেল জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়নি। সে নিজেই সোহেলকে ডেকে এনে তার সঙ্গে চলে গেছে। মৃদুল ও সোহেল পুলিশকে জানিয়েছে- তাদের প্রেম অনেক দিন ধরে। ওই সময় মৃদুল বসবাস করতো নগরীর মেজরটিলা ইসলামের মামার বাসায়। সোহেল ও মৃদুল পড়ালেখা করতো উপশহরের জামেয়া স্কুলে। তারা একই ক্লাসের শিক্ষার্থী ছিল। আর ওই সময় থেকেই তারা দুই জন প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৩ সালে তারা ওই প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেয়।
পরীক্ষার পর সোহেলের সঙ্গে পালিয়ে যায় মৃদুল। সোহেলের সঙ্গে মৃদুলের প্রেমের সম্পর্ক কোনোভাবে মেনে নিতে পারেনি পরিবার। এ কারণে তারা দু’জন একে অপরের হাত ধরে অজানায় পাড়ি জমায়। তবে- ওই সময় তারা বিয়ে করেনি। পরে স্থানীয় মুরব্বিদের মুধ্যস্থতায় বিষয়টি মীমাংসা হয়। অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় সোহেল ও মৃদুল তাদের যার যার বাড়িতে চলে যায়। তবে- দু’জনের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। এ ঘটনার পর মৃদুলকে তার মা রওশন আরা নিয়ে যান ওসমানীনগরের রাইকদারা গ্রামের বাড়িতে। মৃদুলকে তারা সোহেলের সঙ্গ ছাড়াতে অনেক চেষ্টা করেন। এই চেষ্টার মধ্যও ২০১৫ সালে সোহেল ও মৃদুল গোপনে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তারা প্রথমে এফিডেভিট এবং পরে কাবিনের মাধ্যমে বিয়ে করে। বিয়ের পর মৃদুল ফের তার মায়ের কাছে চলে যায়।
এদিকে- কাবিন সম্পন্ন হওয়ার পর সোহেল আরমান তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য বারবার মৃদুলের পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু মৃদুলের পরিবার সোহেলের কথায় কান দেয়নি। উল্টো এ নিয়ে তারা মৃদুলকে মানসিকভাবে নির্যাতন শুরু করেন। কিন্তু মৃদুল প্রেমিক সোহেলের সঙ্গ ছাড়েনি। এই অবস্থায় সোহেল সিলেটের আদালতের শরণাপন্ন হয়। তিনি কাবিন দিয়ে আদালতে মামলা করে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দেয়ার আর্জি জানান। তার এই আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ইতিমধ্যে মৃদুলের বিরুদ্ধে সার্চ ওয়ারেন্ট জারি করেন।
এদিকে- সার্চ ওয়ারেন্ট বের হওয়ায় খবর পেয়ে তটস্থ হয়ে উঠেন মৃদুলের মা রওশন আরা। তিনি মেয়েকে পুলিশের হাত থেকে মুক্ত করতে নগরীর মেজরটিলা ইসলামপুরে থাকা ভাই মুহিবুল ইসলামকে ফোন করেন। বোনের ফোন পেয়ে মুহিবুল বৃহস্পতিবার বিকেলে যান বোনের স্বামীর বাড়ি ওসমানীনগরের রাইকদারা গ্রামে। সেখানে গিয়ে তিনি বোন রওশন ও ভাগ্নি মৃদুলকে সিএনজি অটোরিকশাতে নিয়ে নিজ এলাকায় মেজরটিলা ইসলামপুরে ফিরছিলেন। রাত তখন সাড়ে ১০টা।
সিলেট নগরীর উপশহরের এবিসি পয়েন্টে তখন শাহপরাণ থানা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নুরুল ইসলাম চেকপোস্ট বসিয়ে গাড়ি তল্লাশি করছিলেন। এমন সময় চেকপোস্টে গিয়ে থামে মৃদুলের মামার গাড়ি। পুলিশ যখন গাড়ি তল্লাশি চালাচ্ছিল তখন গাড়ি থেকে নেমে পাশের একটি মার্কেটের সামনে মা রওশনের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন মৃদুল। এ সময় সোহেল আরমান ও তার বন্ধুরা দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে সেখানে পৌঁছে। তারা মোটরসাইকেল দাঁড় করাতেই মৃদুল গিয়ে সোহেলের মোটরসাইকেলে চেপে বসে। এ সময় পেছন থেকে মা রওশন মেয়েকে ঝাপটা ধরেন। এবং তার মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে চিৎকার করতে থাকেন।
চিৎকার শুনে সেখানে দৌড়ে আসেন মৃদুলের মামা মুহিবুল ও গাড়ি চালক সাবু মিয়া। তারা মৃদুলকে মোটরসাইকেল থেকে নামিয়ে আনতে টানাহিঁচড়া করেন। কিন্তু মৃদুল নামেনি। বরং সে প্রেমিক সোহেলের সঙ্গে মোটরসাইকেলে চলে যায়। এদিকে- ঘটনাস্থলে অদূরে চেকপোস্টে পুলিশ দল। তারা মৃদুলকে উদ্ধারে চেষ্টা না করায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ে। মৃদুলকে অপহরণ করা হয়েছে- মায়ের এ দাবিতে ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় লোকজন উপশহরের মূল সড়কে অবরোধ করেন। ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান শাহপরাণ থানার ওসি আক্তার হোসেন।
এরই মধ্যে অবরোধস্থলে খবর পৌঁছে- ওই তরুণী অপহৃত হয়নি, সে তার স্বামীর সঙ্গে চলে গেছে। এ খবর জানার পর স্থানীয় লোকজন রাস্তা থেকে সরে যান। এদিকে- মৃদুল চলে যাওয়ার পর রাতে থানায় যান তার মা রওশন আরা ও মামা মুহিবুল ইসলাম। তারা প্রথমে পুলিশের কাছে অতীত ঘটনা লুকিয়ে রাখেন। তবে- পুলিশ মৃদুলকে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন। মধ্যরাতের দিকে সোহেল ও মৃদুলকে টিলাগড় এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর রাতে শাহপরাণ থানায় মৃদুলকে পুলিশ তার মায়ের মুখোমুখি করে।
থানা হাজতে মৃদুল মায়ের সামনেই সোহেলকে তার স্বামী বলে স্বীকার করে। একই সঙ্গে সে পালিয়ে যায়নি বলেও জানায়। পুলিশের কাছে তারা কাবিননামাও দেয়। সিলেটের শাহপরাণ থানার ওসি আক্তার হোসেন গতকাল বিকেলে জানিয়েছেন- উদ্ধারের পর তাদের কাবিন দেখে জানা গেছে তারা স্বামী-স্ত্রী। বিয়ের আগেও তারা একবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল। -এমজমিন
২৯ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি