মারুফ হাসান: ক্বীন ব্রীজের বয়স হয়েছে, তাকে বিশ্রাম দিতে হবে। সব জিনিসের একটি নির্ধারিত মেয়াদ থাকে, সেই পর্যন্ত তাকে ব্যবহার করতে হয়। কোনো জিনিসই অনন্তকাল ব্যবহারের জন্য নয়।
দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে ক্বীন ব্রীজ সিলেটের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। সুরমা নদীর ওপর নির্মিত এই ব্রীজ দিয়ে যান চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা প্রয়োজন। নগরীকে পর্যটকের জন্য আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে এর কোনো বিকল্প নেই। সংস্কার ও সংরক্ষণ বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ না নিলে পর্যটনের রাণী সিলেট হারাবে তার রূপ-যৌবন, হারাবে অতীত ঐতিহ্য। আর বরাবরের মতো পর্যটকের আক্ষেপের কারন হয়ে থাকবে ক্বীন ব্রীজ।
সুরমা নদীর সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের মাধ্যমে ক্বীন ব্রীজ এলাকাকে বিনোদন এবং ভ্রমণ পিপাসুদের আকর্ষণের স্থান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। চাঁদনিঘাট এলাকার এই ব্রীজটির পাশেই রয়েছে ঐতিহাসিক আলী আমজাদের ঘড়ি, রয়েছে সিলেট সার্কিট হাউজ। গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনাগুলোর আশ-পাশ দখল করে নিয়েছে সিএনজি চালিত অটো, ভ্যান, ট্রাক এবং রিকশা চালকেরা। হকার আর ভাসমান মানুষের দখলে চলে গেছে পুরো ফুটপাত।
ঝুকিপূর্ণ হওয়ায় বহু আগেই ক্বীন ব্রীজ দিয়ে ভারী যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে কিছু সিএনজি চালিত অটো, মোটরবাইক আর রিকশা চলাচলের জন্য খুলে রাখা হয়েছে ব্রীজটি। এছাড়াও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পায়ে হেঁটে ক্বীন ব্রীজ দিয়ে নগরীতে আসা-যাওয়া করছেন।
একসময় সিলেটের প্রবেশদ্বার ছিল ক্বীন ব্রীজ। সময়ের ব্যবধানে নগরীতে প্রবেশের জন্য আরো দুটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। একটি ‘শাহজালাল সেতু’ অপরটি ‘কাজিরবাজার সেতু’। এছাড়াও বাইপাস দিয়ে সিলেট নগরীতে প্রবেশের আরো একটি সেতু বিদ্যমান। এতো ব্যবস্থা থাকতেও ক্বীন ব্রীজ দিয়ে এখনো কেন যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক নগরবিদ জহির বিন আলম বলেন, প্রতিটি জিনিসের একটি লাইফ টাইম থাকে, ক্বীন ব্রীজের লাইফ টাইম শেষ হতে চলেছে। এটিকে পর্যটনের আওতায় আনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, দক্ষিণ দিক থেকে নগরীতে প্রবেশের এটি একটি সহজ পথ। সহজ এই পথটিতে শুধুমাত্র রিকশা চলাচলের অনুমতি রেখে বাকি সব যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া উচিত। সেই ক্ষেত্রে রিকশাগুলো যাতে ভারী কোনো মালামাল পরিবহন করতে না পারে সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে।
সব ধরণের যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে অবশ্যই ক্বীন ব্রীজটিকে প্রাইভেটাইজেশন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন সিলেট চেম্বারের সভাপতি খন্দকার সিপার আহমদ। তিনি বলেন, গুটি কয়েক মানুষের স্বার্থের জন্য ব্রীজটিকে পর্যটনের আওতায় নেয়া হচ্ছে না। পর্যটন কর্পোরেশন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলে ক্বীন ব্রীজকে ঘিরে পর্যটকদের মিলনমেলা বসবে সুরমাপারে। তাতে করে সুন্দর হবে পরিবেশ, অগণিত পর্যটকের আগমন ঘটবে, সর্বপরি বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করবে সরকার।
সিপার আহমদ আরো বলেন, সিলেট সার্কিট হাউজের সামনে ট্রাক স্ট্যান্ড ছিল, আদালত পাড়ায় হকারদের মার্কেট ছিল। এখন সেগুলো নেই, কেননা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সচেতন হয়েছেন বলেই গুরুত্বপুর্ণ এই প্রতিষ্ঠানগুলো মুক্ত করতে পেরেছেন। ঠিক একই ভাবে পর্যটন কর্পোরেশনসহ জেলা প্রশাসন আন্তরিক হলে ক্বীন ব্রীজ মুক্ত করা অসম্ভব কিছু নয়।
ক্বীন ব্রীজ দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়ার ব্যবাপারে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে সাংবাদিক কলামিস্ট আফতাব চৌধুরী বলেন, বৃহৎ স্বার্থের কথা ভেবে ক্ষুদ্র স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। ক্বীন ব্রীজ বিশ্বের দরবারে সিলেটের লগো। এর সংরক্ষণ জরুরী। ক্বীন ব্রীজের দুপাশকে পরিকল্পিত ভাবে সাজালে নগরবাসীতো বটেই পর্যটকদের জন্য এ হবে অবকাশ যাপনের এক অনন্য উদাহরণ। পায়ে হেঁটে মানুষের যাতায়াতের সুযোগ রেখে এই ব্রীজকে পর্যটনের আওতায় আনা যেতে পারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, প্রাচীন ক্বীন ব্রীজ যান চলাচলের জন্য পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়ে এই এলাকাটি পর্যটকদের জন্য আকর্ষনীয় ভাবে সাজানো যেতে পারে। আপাতত ব্রীজটিতে সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ করা সম্ভব না হলেও শুক্রবার ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন পরীক্ষামূলক ভাবে বন্ধ রাখা যেতে পারে। ছুটির এই দিনগুলোতে শুধুমাত্র পথচারীদের জন্য খোলা রাখার আহ্বান জানিয়ে কিম বলেন, এতে করে সিলেট বেড়াতে আসা পর্যটকসহ নগরবাসী অন্তত সুরমা নদী তীরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ লাভ করবেন।
লেখক ও সাংবাদিক ফোরামের লণ্ডন শাখার সভাপতি বাতিরুল হক সরদার বলেন, পর্যটন নগরী সিলেটকে অত্যাধুনিক ভাবে রূপান্তর এবং পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হলে ঐতিহাসিক স্থান গুলোকে নতুন রূপে সাজাতে হবে। সেই হিসাবে ক্বীন ব্রীজ দিয়ে যাতায়াতকারী যানবাহন বন্ধ করে পার্শ্ববর্তী ব্রীজ দিয়ে চলাচলের ব্যবস্থা করলে ভালো হবে।
ক্বীন ব্রীজ কেবল জনসাধারণের জন্য উন্মোক্ত করে দিলে সিলেটের পর্যটনে নতুন হাওয়া লাগবে বলে বিশ্বাস করেন প্রবাসী এই সাংবাদিক।
সুইডেন প্রবাসী ড. মনজুর কাদের বলেন, পর্যটনে অপার সম্ভাবনার হাতছানি আছে সিলেটকে ঘিরে। এ বিষয়টি নতুন করে বলবার কিছু নেই। দেশি-বিদেশী পর্যটকদের কাছে সিলেটের ক্বীন ব্রীজ একটি অন্যতম আকর্ষণ। শুধুমাত্র যান চলাচল এবং হকারদের দৌরাত্মের কারনে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে মনভরে দেখার সুযোগ হয়না অনেকের। সিলেটের পর্যটনকে এগিয়ে নিতে পরিকল্পনার মাধ্যমে নগরায়নের সময় এসেছে। আমি মনে করি ক্বীন ব্রীজ দিয়ে যান চলাচল একেবারে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
ক্বীন ব্রীজ সংরক্ষণ করতে না পারলে সিলেট তার রূপ-যৌবন হারাবে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য ও কাতার-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি সভাপতি আহমেদ রিয়াজ। তিনি বলেন, সিলেটের এই ব্রীজকে রক্ষা করতে এরশাদ সরকারের আমলে উপশহর এলাকায় নতুন ব্রিজ নির্মিত হয়, এরপর ২০১৫ সালে নির্মিত হয় কাজিরবাজার সেতু। দুটি সেতুই সব ধরণের যানবাহন চলাচলের উপযুক্ত করে তৈরী করা হয়েছে। কোন অদৃশ্য শক্তির বলে ক্বীন ব্রীজটিকে যানমুক্ত করা হচ্ছে না সেটি আমার বোধগম্য নয়।
রিয়াজ বলেন, লন্ডনের টমাস নদের আদলে সিলেটের সুরমা নদীকে সাজাতে হবে। ব্রিজটিকে অক্ষত রাখতে হলে এখন থেকে তা সংরক্ষণ করতে হবে। বৃটিশদের এই স্থাপনা আগামী এক হাজার বছরেও কেউ সৃষ্টি করতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেন আহমেদ রিয়াজ।
সিলেটে বেড়াতে আসা নোয়াখালী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক তাহসিনা আক্তার লোপা বলেন, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রী-শিক্ষক মিলে প্রায় ১শ জনের একটি টিম বেড়ানোর জন্য সিলেটে গিয়েছিলাম। তিন দিন সময়ে আমরা সিলেট শহরের অনেক কিছুই দেখেছি। দেখিনি শুধু ঐতিহ্যবাহী ক্বীন ব্রীজ। শুনেছি ক্বীন ব্রীজ এলাকায় সব সময় যানজট লেগেই থাকে, তাছাড়া হকার, ছিনতাইকারী, হিজরা আর ফুটপাত দখলদারদের দৌরাত্মে পরিবেশটা শিশুদের উপযুক্ত নয়। তাই যাওয়া হয়নি। লোপা আরো বলেন, পত্র পত্রিকায় ক্বীন ব্রীজের অনেক ছবি দেখেছি, ভেবেছিলাম বাচ্চাদের নিয়ে একটি সেলফি তুলবো এইসব শুনে যাওয়ার সাহস পাইনি।
এলাকাটি পর্যটনের আওতায় আসলে দূর দূরান্ত থেকে বেড়াতে আসা মানুষজন সিলেটের এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সাথে কিছুটা আনন্দঘন মূহুর্তের স্বাক্ষী হতে পারবে বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
ফোক গানের শিল্পী শিমুল খান বলেন, ”সুরমা নদীর তীরে আমার ঠিকানারে, বাবা শাহজালালের দেশ সিলেট ভূমি রে”। অপূর্ব এই গানটির সাথে মিশে আছে সিলেটের সৌন্দর্য, রূপ-বৌচিত্র। আমি বেশ কয়েকবার সিলেটে গিয়েছি। আমি গানের মানুষ। সেই অনুভব থেকে বলতে চাই সিলেটের সৌন্দর্য ক্বীন ব্রীজ। সেই সৌন্দর্য বিলিন হোক এটি কারো কাম্য নয়। ক্বীন ব্রীজ সংরক্ষণে সংশ্লিষ্টরা সব রকম প্রয়োয়নীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এটাই কামনা করছি।
পর্যটন শিল্পে সিলেট এগিয়ে যাবে বহু দূর, এমনই স্বপ্ন লালন করেন সিলেট টুরিজম ক্লাবের সভাপতি সাংবাদিক হুমায়ূন কবীর লিটন। ক্বীন ব্রীজ দিয়ে যান চলাচল বন্ধের বিষয়ে তিনি ভিন্ন মত পোষন করেন। লিটন বলেন, এই ক্বীন ব্রীজকে কেন্দ্র করে সুরমা নদীর দুপাশে গড়ে উঠেছে প্রায় হাজার খানেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে এলাকার প্রতিটি ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাছাড়া কদমতলী বাস স্টেন্ড এবং রেলস্টেশন থেকে নগরীতে সহজে প্রবেশের এটিই একমাত্র পথ।
ক্বীন ব্রীজকে রক্ষা এবং পর্যটন খাতে এর ভূমিকা নিয়ে সমাজের বিশিষ্টজনরা নানা কথা বলেছেন। তাদের কথায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ক্বীন ব্রীজের উপর দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করার বিষয়টি। সিলেটের এই ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন অনেকে। সিলেটের পর্যটনে ব্রীজটিকে ঘিরে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে বলেও আশা করছেন সচেতন সমাজ।
উল্লেখ্য, ৮২ বছরে পা দিয়েছে ক্বীন ব্রীজ। আসাম প্রদেশের গভর্ণর মাইকেল ক্বীন সিলেট সফরে আসার জন্য সুরমা নদীতে ব্রীজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কারণ তখন আসামের সাথে সিলেটের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ট্রেন। ফলে, রেলওয়ে বিভাগ ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর ওপর ব্রীজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এবং নির্মাণ শেষে ১৯৩৬ সালে ব্রীজটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়। মাইকেল ক্বীন-এর নামানুসারে ব্রীজের নাম রাখা হয় ক্বীন ব্রীজ। ১১৫০ ফুট দৈর্ঘ্যে ও ১৮ ফুট প্রস্থের ক্বীন ব্রীজটি লোহা দিয়ে তৈরী। এর আকৃতি ধনুকের ছিলার মত বাঁকানো। ব্রীজটি নির্মাণে তৎকালীন সময়ে ব্যয় হয়েছিলো প্রায় ৫৬ লাখ টাকা।