উজ্জ্বল মেহেদী ও সুমনকুমার দাশ, সিলেট:
*বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলা নিয়ে সিলেট-২ আসন
*১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সাংসদ হন বিএনপির ইলিয়াস আলী
*২০১৪ সালের নির্বাচনে জাপাকে আসনটি ছেড়ে দেয় আ. লীগ
*ইলিয়াসের স্ত্রী লুনা বিএনপির মনোনয়ন পাবেন বলে প্রচার আছে
*আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকা বেশ দীর্ঘ
সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) আসনে টানা তিনবার নির্বাচন করেছিলেন এম ইলিয়াস আলী। বিএনপির ‘নিখোঁজ’ এই নেতা বিজয়ী হয়েছিলেন দুবার। নিখোঁজ হলেও ভোটের রাজনীতিতে যেন দৃশ্যমান হয়ে উঠছেন তিনি। নির্বাচনের রাজনীতিতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ইলিয়াসের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকা বেশ দীর্ঘ হয়েছে। এ নিয়ে দলের মধ্যে বিভক্তি বেড়েই চলেছে। ইলিয়াস আলীর অনুপস্থিতিতে রাজনীতিতে আসা তাঁর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা দলের মনোনয়ন পাবেন বলে প্রচার আছে।
আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদের এ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছেন ক্ষমতাসীনদের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির বর্তমান সাংসদ ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী। আর ২০-দলীয় জোটের শরিক খেলাফত মজলিসও এখান থেকে নির্বাচন করতে চায়।
বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলার অর্ধশতাধিক ভোটার এবং চারটি রাজনৈতিক দলের ১২ জন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ আসনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে সাংসদ নির্বাচিত হন বিএনপির নেতা এম ইলিয়াস আলী। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিকুর রহমান চৌধুরীর কাছে হেরে যান। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাপাকে আসনটি ছেড়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রের নির্দেশে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন তৎকালীন সাংসদ শফিকুর রহমান চৌধুরী।
আওয়ামী লীগ
জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত বর্তমান সাংসদ মো. ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এবারও প্রার্থী হবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা আওয়ামী লীগের সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরীও এবার প্রার্থী হচ্ছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের যুক্তরাজ্য শাখার যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ তৌফিক রহমান চৌধুরী এবং জেলা আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক জগলু চৌধুরী এ আসনে দলের মনোনয়ন চান। চারজনই দলীয় মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন। এখানে যুক্তরাজ্যে কার্ডিফ আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী মোহাম্মদ শাহজাহানও এরই মধ্যে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ঘিরে এরই মধ্যে দলে মেরুকরণ চলছে। নেতা-কর্মীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ার পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরীণ গৃহবিবাদ চরম রূপ নিয়েছে। নির্বাচনী এলাকার আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন পর্যায়ের পাঁচজন নেতা জানান, দলে এখন দুটি ভাগ। এক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শফিকুর রহমান চৌধুরী এবং অপর পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। দুজনই আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে সমর্থকদের আশ্বাস দিচ্ছেন। এ অবস্থায় কর্মীরাও দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। নির্বাচনের আগে এই বিভক্তি দূর করা না গেলে তাঁদের কোন্দলের প্রভাব দলীয় প্রার্থীর ওপর পড়বে। অতিসম্প্রতি জগলু চৌধুরী নির্বাচন করার ঘোষণা দেওয়ায় বিভক্তি আরও কিছুটা বেড়েছে।
স্থানীয়ভাবে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির ব্যক্তি ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিত তৌফিক রহমান চৌধুরী সিলেটের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। তৌফিক বলেন, ‘এলাকার মানুষের অনুরোধে রাজনীতিতে ইতিবাচক ও গুণগত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে প্রার্থী হতে চাই। দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করব।’
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘আমি গত সংসদ নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলাম। আশা করছি, দল এবার আমাকে মূল্যায়ন করবে। মনোনয়ন পেলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করে বিজয় নিশ্চিত করতে কাজ করব।’
সাবেক সাংসদ শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘গত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন বিএনপি-জামায়াত চক্র নির্বাচন বর্জনের নামে সারা দেশে অরাজকতা চালিয়েছিল। দেশের স্বার্থে জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সাংসদ থাকা সত্ত্বেও আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এবার আমি আশাবাদী, দল আমাকে মূল্যায়ন করবে। মনোনয়ন পেলে অবশ্যই নৌকার বিজয় নিশ্চিত হবে।’
বিএনপি
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ইলিয়াস আলী ‘নিখোঁজ’ থাকায় নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত বাড়ে তাঁর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীরের। তিনি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে আছেন। আসন্ন নির্বাচনে স্বামী ইলিয়াস আলীর অবর্তমানে তাহসিনা রুশদীর বিএনপি থেকে মনোনয়ন পাবেন বলে এলাকায় ব্যাপকভাবে প্রচার রয়েছে। গতকাল তিনি দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন।
ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর এই সংসদীয় এলাকার স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনেই তিনি আলোচনায় ছিলেন। ভোটারদের সহানুভূতি পেতে তাঁর নাম আলোচনায় আনেন অনুসারীরা। এই অবস্থায় এ আসনের তিনটি উপজেলার চেয়ারম্যানই বিএনপি-সমর্থিত। এমনকি ইউপি চেয়ারম্যানদের বেশির ভাগই বিএনপি ঘরানার। এ সুবিধা আগামী সংসদ নির্বাচনেও পাওয়া যাবে বলে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা মনে করেছেন।
ইলিয়াস আলীর অনুপস্থিতিকে দলীয় শক্তি হিসেবে কাজে লাগানো যাবে মন্তব্য করে বিএনপির সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলী আহমদ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, কেবল ইলিয়াস আলীর নামের দোহাই দিয়েই বিএনপির প্রার্থী অনায়াসে জয় পাবেন। এ ছাড়া এই আসনে তাহসিনার বিকল্প কোনো প্রার্থীই নেই।
তাহসিনা রুশদী সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকার মানুষের প্রয়োজনে, ইলিয়াস আলীর অনুপস্থিতির কারণে বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে এসেছি। গত স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে কিছু পথসভা-সমাবেশ করেছি, যাতে মানুষ বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দেন। এর বাইরে আগামী সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত কোনো ভাবনাচিন্তা নেই। দল যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেটিই আমার সিদ্ধান্ত হবে।’ নিখোঁজ হয়েও ভোটের মাঠে দৃশ্যমান থাকা প্রসঙ্গে তাহসিনা আবেগের সুরে বলেন, ‘বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ-ওসমানীনগরের যে রাস্তায়ই আপনি হাঁটবেন, সে রাস্তাই ইলিয়াস আলীর কথা বলবে।’
সিলেট-২ আসন থেকে নির্বাচনে ইচ্ছুক খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নেতা মুহাম্মদ মুনতাসির আলী জানান, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি এই জোটের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে মাঠে তৎপর ছিলেন। তবে বিএনপি আসনটি ছাড়েনি। কেন্দ্রীয় নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী দিনে দুর্নীতিমুক্ত উন্নয়ন ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে খেলাফত মজলিস সিলেট-২ আসনে নির্বাচন করবেই করবে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে এ আসনে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে মাঠে তৎপর শিক্ষানুরাগী হিসেবে পরিচিত এনামুল হক সরদার। তিনি সিলেট জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। এনামুল হক জানিয়েছেন, দলীয় তৎপরতার মধ্যে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সর্বদলীয় নেতা-কর্মী সমর্থকদের সহানুভূতি পাবেন।
সূত্র: প্রথম আলো