সিলেট: ৪৪ বছর আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন বাবা। এত বছর তার কোনো সন্ধান ছিল না। ৪৪ বছর পর ফেসবুকে ছবি দেখে বাবাকে চিনতে পারলেন সন্তানরা। শুক্রবার (১৭ জানুয়ারি) সকালে ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাবাকে তার পরিবারের সদস্যরা ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ১৯৭৫ সালে সিলেটের বিয়ানীবাজার থেকে সিলেট শহরে ব্যবসার কাজে বের হয়েছিলেন হাবিবুর রহমান (৩৬)। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। যখন হাবিবুর রহমান নিখোঁজ হন তখন তার ঘরে চার সন্তান। এর মধ্যে ছোট ছেলের বয়স ছিল ৪০ দিন। সেই ছেলে এখন বড় হয়েছে। বিয়ে করে আছে দুই ছেলেও। এছাড়া তার বড় ভাইদের ছেলেমেয়ে আছে। সেই ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে দাদার হারিয়ে যাওয়ার কাহিনি শুনেছে। শুনেছে পরিবারে আসা হাবিবুর রহমানের ছেলের বউ ও নাতিরাও।
হারিয়ে যাওয়ার পর হাবিবুর রহমানের একটি সাদাকালো ছবি ছিল ঘরে। ওই ছবি দেখেছেন হাবিবুর রহমানের বড় ছেলের বউসহ অন্যরা। বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পড়ে প্রথমে হাবিবুর রহমানকে শনাক্ত করেন তার আমেরিকা প্রবাসী বড় ছেলের বউ। পরে তিনি ওই ছবি পরিবারের অন্য সদস্যদের দেখান। এরপর পরিবারের সদস্যরা শনাক্ত করেন তাকে। পরে শুক্রবার সকালে ওসমানী হাসপাতাল থেকে তাকে উদ্ধার করেন পরিবারের সদস্যরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিখোঁজ হওয়ার পর হাবিবুর রহমান বিভিন্ন মাজারে থাকতেন। এক পর্যায়ে তিনি মৌলভীবাজারের হযরত শাহাব উদ্দিন (রহ.) মাজারে থাকা শুরু করেন। মাজারেই পরিচয় হয় মৌলভীবাজারের রায়শ্রী এলাকার রাজিয়া বেগমের সঙ্গে। রাজিয়া বেগমও মাজার ভক্ত। সেই থেকেই তিনি হাবিবুর রহমানের দেখাশুনা করতেন।
প্রথমে হাবিবুর রহমান চলাফেরা করতে পারলেও বিগত এক যুগ ধরে অনেকটা অচল। এরমধ্যে সর্বশেষ মাসখানেক আগে তিনি নিজের খাট থেকে পড়ে যান। এতে তার ডান হাত ভেঙে যায়। পরে রাজিয়া বেগম তাকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। তবে গত ৬-৭ দিন আগে হাবিবুর রহমানের ভাঙা হাতে ইনফেকশন দেখা দিলে চিকিৎসকরা তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন।
ওসমানী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুদিন আগে ভাঙা হাতে অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তিনি প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে না পারায় অপারেশন করাতে পারেননি। আর এই বিষয়টি হাবিবুর রহমান পাশের সিটের এক জনের সঙ্গে শেয়ার করেন। পরে ওই ব্যক্তি হাবিবুর রহমানের সামগ্রিক বিষয় জানিয়ে নিজের ফেসবুকে আইডি থেকে পোস্ট করে সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
পোস্টে শ্বশুরের ছবি দেখেন আমেরিকা প্রবাসী হাবিবুর রহমানের বড় ছেলের বউ। এরপর তিনি পরিবারের সদস্যদের দেখালে পরিবারের সদস্য অনুমান করেন তিনিই হারিয়ে যাওয়া হাবিবুর রহমান।
পরিবারের সদস্যরা শুক্রবার সকালে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন। তারা হাবিবুর রহমানকে বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞাসা করেন। তবে হাবিবুর রহমান শুধু নিজের স্ত্রীর নাম বলতে পারছিলেন। এরপর পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত করেন তিনিই হারিয়ে যাওয়া হাবিবুর রহমান। এরপর পরিবারের সদস্যরা তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে নগরের সোবহানীঘাটে পাঁচ তারকা মানের বেসরকারি আল হারামাইন হাসপাতালে ভর্তি করেন। বর্তমানে সেখানে তিনি চিকিৎসাধীন আছেন।
হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের ছয় তলার একটি কেবিনে শুয়ে আছেন হাবিবুর রহমান। তাকে ঘিরে আছেন নাতি কেফায়াত আহমদসহ পরিবারের অন্যরা। সবমিলিয়ে হাসপাতালের কেবিন যেন এক উৎসবের আমেজ। সবাই একে অন্যর দিকে থাকাচ্ছেন, কেউ কেউ কৌতূহলী প্রশ্নও করছেন হাবিবুর রহমানকে।
পরিবারের সদস্যরা জানালেন, তিনি দীর্ঘক্ষণ পরপর উত্তর দেন এবং বুঝতে পারার ওপর নির্ভর করেই কবেল প্রশ্নের উত্তর দেন। পরিবারের সদস্যরা তাকে দীর্ঘদিন না আসার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা (তারা বলতে তিনি কাকে বুঝাতে চেয়েছেন তা খুলে বলতে পারেননি) আমাকে আসতে দেয়নি। তবে তার নাম জিজ্ঞেস করলেই তিনি বলে ওঠেন তার নাম হাবিবুর রহমান। স্ত্রীর নাম কী জিজ্ঞেস করলে বলেন, জয়গুন নেছা।
মাজারে হাবিবুর রহমানের দেখাশোনাকারী রাজিয়া বেগম বলেন, প্রায় ২৫ বছর আগে এক মাজারে হাবিবুর রহমানের সঙ্গে তার পরিবারের দেখা হয়। সেই সুবাধে তিনি আমাদের পরিচিত হয়ে ওঠেন। আমিও তাকে সম্মান করে ‘পীর সাহেব’ বলে ডাকি। এরপর থেকেই আমি তার দেখাশুনা করছি।
হাবিবুর রহমানের ছেলে জালাল উদ্দিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় চার বছর পর বাবা ব্যবসার উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন। এরপর আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পায়নি। এর মধ্যে ২০০০ সালে আমার মা মারা যান।
জালাল জানান, তার বাবা যখন হারিয়ে যান তখন তারা বিয়ানীবাজারের বেজগ্রামে বসবাস করতেন। বর্তমানে তাদের পরিবারের সদস্যরা বিয়ানীবাজার পৌরসভার কবসা এলাকার বাসায় বসবাস করছেন।
দীর্ঘ ৪৪ বছর পর বাবাকে ফিরে পাওয়াকে ‘অবিশ্বাস্য’ উল্লেখ করে জালাল বলেন, এটা রীতিমতো স্বপ্নের। কারণ এক দুবছর নয়, দীর্ঘ ৪৪ বছর পরে তাকে আমরা পেয়েছি। আমাদের সন্তানরা তাদের দাদাকে পেয়ে খুবই খুশি। আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।