সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিহত চাঞ্চল্যকর রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় এসআই আকবরসহ ছয়জনকে অভিযুক্ত করে বুধবার (৫ মে) আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
ইয়াবা সেবনকারী সাইদুল শেখের ছিনতাইয়ের মিথ্যা অভিযোগে রায়হান উদ্দিনকে পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই সাইদুল শেখ প্রতারণা মামলায় এখনো জেলে আছেন। আর এসআই আকবরসহ পুলিশের অন্য সদস্যরা কারান্তরীণ রায়হান হত্যা মামলায়।
গত বছরের ১১ অক্টোবর ভোররাতে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে ওই রাতেই কোতোয়ালি থানায় হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা দায়ের করেন।
অভিযোগপত্র দাখিলের পর ব্রিফিংকালে পিবিআই সিলেটের বিশেষ পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান বলেন, ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ৩০২, ২০১ ধারায় অপরাধ হলেও তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। নির্যাতনে হেফাজতে মৃত্যুর ২০১৩ এর ১৫ (২ ও (৩) ধারায় অভিযুক্তদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ দু’টি আইনের একটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ও অপরটিতে সর্বনিম্ন শাস্তি আমৃত্যু যাবজ্জীবন। আমরা তদন্তে চেষ্টা করেছি, যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হয়। আর এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে সিলেটের বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক ইনচার্জ বরখাস্তকৃত এসআই আকবর হোসেনের মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।
১৯৬২ পৃষ্ঠার এ অভিযোগপত্রে ৬৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, সাক্ষীদের মধ্যে ১০ জন ১৬৪ ধারায় আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এদের মধ্যে সাতজনই পুলিশ সদস্য। রায়হানের শরীরে ১১১ আঘাতের চিহ্ন নিরূপণকারী ফরেনসিক চিকিৎসককেও মামলায় সাক্ষী হিসেবে রাখা হয়েছে।
তবে রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতন পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না কিংবা পূর্ব বিরোধের জের থেকে নয় বলে জানিয়ে খালেদ উজ জামান বলেন, তদন্তকালে মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা ছিনতাই রোধে জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছেন। আর মহানগর এলাকায় মধ্যরাত থেকে ভোররাতে ছিনতাই হয়। সে সুবাদে ছিনতাইয়ের অভিযোগে রায়হানকে কাস্টঘর থেকে ধরে আনা হয়।
তিনি বলেন, তদন্তে রায়হানকে ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে নির্যাতনে এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া, এএসআই আশেকে এলাহি, পুলিশের কনস্টেবল হারুনুর রশিদ ও টিটু চন্দ্র দাস নির্যাতনে অংশ নেন বলে তদন্তে প্রমাণ মিলেছে। আর নির্যাতনের আলামত নষ্ট ও অভিযুক্তদের পালাতে সহায়তা করেন বহিষ্কৃত এএসআই হাসান উদ্দিন এবং কথিত সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান। অভিযোগপত্রে এ ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
রায়হানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন, সাইদুল শেখ নামের এক ব্যক্তির করা ছিনতাইয়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রায়হানকে কাস্টঘর থেকে ধরে আনে পুলিশ। ছিনতাইয়ের অভিযোগ করা সাইদুল শেখের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা হয়েছে। কারণ সাইদুল সঙ্গীয় রনি শেখসহ ওই রাতে কাস্টঘর এলাকায় যান ইয়াবা কিনতে। ইয়াবা নিয়ে আসে এক শিশু। কিন্তু নকল ইয়াবা দেওয়ায় টাকা ফেরত চান। তখন শিশুটি যে লোকগুলোকে ডেকে আনে তাদের একজন রায়হানও ছিল বলে জানান তিনি।
ঘটনার রাতে ভিকটিম রায়হান কেন ওখানে ছিলেন এর সূত্র ধরে তদন্তে পুলিশ দেখতে পায়, ২০০৮ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটি মামলায় রায়হান আসামি ছিলেন পরবর্তীতে খালাস পান। তার বিরুদ্ধে আরেকটি মাদক মামলাও আদালতে বিচারাধীন পাওয়া যায়।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই পুলিশ সুপার বলেন, সাইদু্লের অভিযোগ পেয়ে রায়হানকে কাস্টঘর থেকে ধরে আনে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে জিজ্ঞাসবাদকালে মারধর করায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান।
এদিকে রায়হানের মা সালমা বেগম প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছেন অন্য কারো ইন্ধনে পূর্ব পরিকল্পনার জেরে রায়হানকে তুলে এনে নির্যাতন করেছে পুলিশ।
নিহত রায়হান উদ্দিন (৩০) নগরের আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা। গত ১০ অক্টোবর রাতে নগরের কাস্টঘর থেকে তাকে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর কয়েক ঘণ্টা চলে নির্যাতন। ১১ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৬টায় রায়হানকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতপালে নেওয়া হয়। পরে সকাল ৭টা ৫০ মিনিটের দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক। ওই রাতেই হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন।
ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিহত রায়হানের মরদেহে ১১১টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এসব আঘাতের ৯৭টি ফোলা আঘাত ও ১৪টি ছিল গুরুতর জখমের চিহ্ন। এসব আঘাতগুলো লাঠি দ্বারাই করা হয়েছে। অসংখ্য আঘাতের কারণে হাইপোভলিউমিক শক ও নিউরোজেনিক শকে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে।
রায়হান হত্যার বিচার দাবিতে সিলেটজুড়ে গণ-আন্দোলন শুরু হয়। অবশেষে প্রায় সাত মাসের মাথায় চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হলো।-সূত্র: কালের কণ্ঠ