ওয়েছ খছরু: নাইমা আক্তার সেতুর বয়স ১২ বছর। কুমিল্লা জেলার কাচিয়াতুলি আদর্শ সদরের একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। কয়েক বছর ধরে মা সালেহা খানমের কাছে বায়না ধরছে জন্মদাতা পিতাকে দেখবে। কিন্তু পিতা শওকতকে তো আর মিলে না। তিনি লন্ডন প্রবাসী। দেশে এলে সালেহাকে এড়িয়ে চলেন। দেখা করেন না। এবার দেশে আসার পর শওকতের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন সালেহা। বলেন, ‘মেয়ে আপনাকে দেখতে চাইছে। সালেহার এ আহ্বানে সাড়া দেন লন্ডন প্রবাসী শওকত আলী। বলেন, কুমিল্লা থেকে মেয়েকে নিয়ে সিলেটে আসতে। স্বামীর অনুমতি পেয়ে সেতুকে নিয়ে বুধবার সিলেটে আসেন সালেহা। জন্মের পর পিতাকে দেখবে- এ জন্য মন ছটফট করছিল সেতুরও।
বুধবার তারা সিলেটের হাউজিং এস্টেটের বাসায় শওকতের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। শওকত তাদের দেখেই চটে যান। লোহার রড দিয়ে মারধর করেন সালেহা খানমকে। বাদ যায়নি সেতুও। যে পিতাকে দেখতে কুমিল্লা থেকে সিলেটে এসেছে আগ্রহ ভরে, সেই পিতার রুদ্রমূর্তি নির্বাক করে দিয়েছে সেতুকে। এখন শুধুই কাঁদছে সে। সালেহা খানমের বাড়ি কুমিল্লায়। আর লন্ডন প্রবাসী শওকত আলীর বাড়ি সিলেটে। সিলেট নগরীর হাউজিং এস্টেট এলাকার ৮ নম্বর বাসার মালিক শওকত। ২০০১ সালে প্রেমের টানে শওকতের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসেন সালেহা। এরপর উভয় পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নেয়। শুরু হয় তাদের সংসার জীবন। শওকত কখনো তাকে নিয়ে ঢাকা, কখনো সিলেটে থাকতেন। ঢাকা ও সিলেটে শওকতের নিজের বাড়ি রয়েছে।
২০০৩ সালে সেতুর জন্ম হয়। এরপর থেকে বেঁকে যান শওকত। সালেহার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেন। এমনকি যোগাযোগও বন্ধ করে দেন। তখন সালেহা সিলেটেই ছিলেন। কিন্তু বারবার শওকতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে যান কুমিল্লায় পিতার বাড়িতে। সেখানে মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছিলেন। তবে বারবার ওখান থেকেও শওকতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। কখনো পেয়েছেন, কখনো পাননি। এরই মধ্যে সেতুর বয়স ১২ বছর হয়েছে। জন্মের ৬ বছর পর থেকে সেতু তার বাবার জন্য অস্থির। মেয়ের আবদার বারবার পাশ কাটিয়ে যেতে চেয়েছেন সালেহা খানম। কিন্তু মেয়ে যত বড় হচ্ছে ততই বাবার জন্য আরো অস্থির হয়ে উঠছে। বাবাকে দেখবেই- এমন পণ করে আছে সে। মেয়ের ইচ্ছা পূরণে আগ্রহী হয়ে উঠেন সালেহা খানম। চলতি মাসে লন্ডন থেকে দেশে ফিরেন শওকত আলী।
এ খবর পেয়ে শওকতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সালেহা। বলেন, ‘মেয়ে আপনাকে দেখতে চাইছে। পিতাকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।’ সালেহা যোগাযোগের পর শওকত তাদের সিলেটে আসার আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণ পেয়ে বুধবার বিকালে সালেহা বেগম মেয়ে সেতুকে নিয়ে সিলেটে আসেন। যান স্বামী শওকতের বাসায়। তিনি বাসার যাওয়ার পর শওকতকেই পান। কিন্তু শওকত তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। বেরিয়ে যান ঘর থেকে। এ সময় শওকতের ঘরে আরো একজন মহিলা ছিল। কিছুক্ষণ পর বাসায় ফিরেন শওকত। এ সময় সালেহা শওকতের সঙ্গে কথা বলতে যান। মেয়েকেও নিয়ে যান সামনে। জানতে চান ঘরে থাকা ওই মহিলা কে। শওকত এ সময় সালেহা ও সেতুকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালান।
একপর্যায়ে শওকত লোহার রড দিয়ে সালেহাকে মারধর শুরু করেন। এ দৃশ্য দেখে মাকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেলে মেয়ে সেতুকে মারধর করেন শওকত। তাদের জোরপূর্বক বাসা থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা চালান। শকওত শুধু একাই মারধর করেননি, তার নিজস্ব সিএনজি চালক কওছরকে নিয়ে এসেও স্ত্রী সালেহার ওপর নির্যাতন চালান। খবর পেয়ে শওকতের বাসায় ছুটে আসেন সিলেট সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও স্থানীয় কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদি। তিনি আসার আগেই স্থানীয় লোকজন জড়ো হয়ে এ দৃশ্য দেখে শওকতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কিন্তু কাউন্সিলর আসার আগেই শওকত ও তার গাড়িচালক বাসা থেকে পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে ছুটে আসে এয়ারপোর্ট থানার পুলিশও।
সালেহা খানম জানিয়েছেন, চলতি মাসে লন্ডন থেকে সিলেট আসেন শওকত। এ খবর পেয়ে সেতু তার বাবাকে দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করে। তাই বুধবার মেয়েকে নিয়ে কুমিল্লা থেকে সিলেটে আসেন। তিনি বলেন, আমি তো শওকতের কাছে আসতে চাইনি। মেয়ের আবদার রক্ষা করতে অনুমতি নিয়ে এসেছি। কিন্তু যে মেয়ে বুকভরা আশা নিয়ে বাবাকে দেখতে এসেছিল, সে-ই এখন নির্বাক হয়ে গেছে। শুধুই কাঁদছে। এদিকে, নির্যাতনের ঘটনায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সালেহা। পুলিশ তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিয়েছে। এরপর থানায় এজাহার দাখিল করেন সালেহা। সিলেটের এয়ারপোর্ট থানার এসআই জালাল জানিয়েছেন, সালেহাকে মারধরের ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ শওকতকে খুঁজছে।
প্যানেল মেয়র রেজাউল হাসান কয়েস লোদি জানিয়েছেন, ‘মেয়েটি এসেছিল বাবাকে দেখতে। তিনি বলেন, মেয়ের অধিকার ফিরিয়ে দিতে যা করা প্রয়োজন আমরা তা-ই করবো।’ এখন সালেহা সেতুকে নিয়ে শওকতের বাসায় এক ভাড়াটিয়ার কক্ষে অবস্থান করছেন। এলাকাবাসীই তাকে এখানে রেখেছে বলে জানিয়েছেন সালেহা। বলেন, ‘এলাকার লোকজন সব ঘটনা জানেন। স্থানীয় কাউন্সিলর ও এলাকার লোকজন যা বলবে আমি তা-ই করবো।’ এদিকে, সালেহা নির্যাতনের ঘটনার পর লন্ডন প্রবাসী শওকতের আসল রূপ বেরিয়ে এসেছে। লন্ডনে রয়েছে শওকতের প্রথম স্ত্রী। সেই স্ত্রীর ঘরে সন্তানাদি রয়েছে। এরপর সালেহাকে বিয়ে করেছিল শওকত। এই বিয়েতে দুই পরিবার রাজি ছিল। কিন্তু এরপর শওকত আরো দুটি বিয়ে করেছেন। সেসব বিয়ে সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন। বুধবার তার বাসায় যে মহিলা ছিল, সে-ও স্ত্রী পরিচয়ে শওকতের সঙ্গে ঘর-সংসার করছে।-এমজমিন
২১ মে, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ