চৌধুরী মুমতাজ আহমদ: ‘কুকা পণ্ডিতের বই’। তন্ত্রমন্ত্রের সংগ্রহ হিসেবে তুকতাক-জাদুটোনায় বিশ্বাসীদের কাছে খুবই ‘মূল্যবান’ বই এটি। এমন একটি বই ছিল সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার মেওয়া গ্রামের নজরুল ইসলাম ওরফে নুনু মৌলভীর কাছে। স্থানীয় মসজিদের ইমাম নুনু মৌলভী বইয়ের সাহায্যে কিছুটা তুকতাক করতে থাকেন, দু-দশ গ্রামে তার পরিচিতি বাড়ে। তন্ত্রমন্ত্র জানার কারণে অনেকে তাকে ভয়ও পেতে থাকেন। নুনু মৌলভীর শিষ্য ছিলেন গ্রামের মাদরাসা ছাত্র নজরুল ইসলাম দিনার। ওস্তাদের মতো ‘নাম কামানো’র স্বপ্নে বিভোর দিনার চুরি করেন ‘কুকা পণ্ডিতের বই’। এক রাতে খুন হন মাদরাসা ছাত্র দিনার। ঘটনাটি ১৯৯২ সালের ২৪শে মে।
এ ঘটনায় শুরু থেকেই মূল সন্দেহভাজন ছিলেন নজরুল ইসলাম ওরফে নুনু মৌলভী। পুলিশ নুনু মৌলভীকে আটক করলেও স্থানীয় প্রভাবশালী ও এককালের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান চৌধুরী জিম্মাদার হয়ে রক্ষা করেন নুনু মৌলভীকে। আর সাবেক এ চেয়ারম্যান যাদের সঙ্গে তার পুরনো বিরোধ রয়েছে তাদেরই পুলিশের সঙ্গে মিলে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করেন- এমনই অভিযোগ জেলে অন্তরীণে থাকা অভিযুক্তের স্বজনদের। ঘটনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগের কারণে নজরুল ইসলামকে মামলা থেকে মুক্ত করতে না পারলেও তাকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন আবদুল হান্নান। নুনু মৌলভী পলাতক থাকা অবস্থায়ই ১৯৯৫ সালে এ মামলার অভিযোগ গঠন হয় ৭ জনের বিরুদ্ধে। আরেক অভিযুক্ত একই গ্রামের এনামউদ্দিনও পলাতক রয়ে যান। তাদের পলাতক রেখেই রায় হয় ১৯৯৯ সালে। নুনু মৌলভীসহ ৭ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
২০১৪ সালের ৭ই মার্চ সিলেট জেলা পুলিশের বিশেষ অভিযানে আটক করা হয় বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত ১৭ জনকে। আটক হন বিয়ানীবাজার উপজেলার মেওয়া গ্রামের বাসিন্দা নূরুল ইসলাম। পুলিশ তাকে আটক করে ২২ বছর আগের দিনার হত্যা মামলায় পলাতক আসামি হিসেবে। অথচ ঐ ঘটনার সময় তিনি দেশেই ছিলেন না, মামলার অভিযুক্তের তালিকায়ও তার নাম ছিল না। ঐ মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন তার ছোট ভাই মাওলানা নজরুল ইসলাম ওরফে নুনু মৌলভী। মাদরাসা শিক্ষার ধারে-কাছে না গেলেও নূরুল ইসলামকেই নুনু মৌলভী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পুলিশের কাছে নাকি নূরুল ইসলাম তখন বলেও ছিলেন তিনি নুনু মৌলভী নন। কিন্তু পুলিশ তার কথা শোনেনি। তাই ২ বছর ধরে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্য মানুষের হয়ে সাজা খাটছেন নূরুল ইসলাম। পুলিশ না শুনলেও নিজের এ দাবি প্রতিষ্ঠায় অটল থাকেন নূরুল ইসলাম।
কারা কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে তিনি বিষয়টি জানান। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ছগির মিয়া বিষয়টি তলিয়ে দেখেন। এ মামলায় কারাগারে বন্দি থাকা অন্য ৫ আসামির প্রত্যেকেই স্বীকার করেন, নূরুল ইসলাম নন তার ছোটভাই নজরুল ইসলামই নুনু মৌলভী- যিনি বাইরে রয়ে গেছেন এখনও। ২০১৫ সালের ২রা নভেম্বর নূরুল ইসলামের আবেদনসহ বিষয়টি সিলেটের জেলা ও দায়রা জজকে অবহিত করেন সিনিয়র জেল সুপার ছগির মিয়া।
গত ১৭ই মে তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নজরেও আনেন বিষয়টি। এর আগে ২৬শে এপ্রিল আরো একবার বিষয়টি অবহিত করেন জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সিলেটের চেয়ারম্যান ও জেলা এবং দায়রা জজকে। ১৯৮৮ সালে জীবিকার সন্ধানে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন নূরুল ইসলাম। সেখানে রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে কাজ করতেন তিনি। ১০ বছর তিনি আর দেশে আসেননি। অথচ এ সময়ের মধ্যে তার গ্রামে ঘটে যাওয়া হত্যা ঘটনায় জেল খাটছেন নূরুল ইসলাম। ১৯৯৮ সালে দেশে ফিরে আসার পর বিয়ে করে সংসারী হয়েছিলেন নূরুল ইসলাম। একে একে ৩ সন্তানের পিতাও হন তিনি। দেশে ফেরার ১৬ বছর পর হঠাৎই নূরুল ইসলামকে অন্যের পরিচয়ে ১৯৯২ সালের দিনার হত্যা ঘটনায় ২০১৪ সালের ৭ই মার্চ আটক করে পুলিশ। তার কাঁধে চাপায় ২২ বছর আগের দিনার হত্যার দায়। অথচ পলাতক আসামি নজরুল ইসলাম ওরফে নুনু মৌলভী ঠিকই পলাতক রয়ে গেছেন। নূরুল ইসলামের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মামলার প্রকৃত অভিযুক্ত নজরুল ইসলাম হত্যা ঘটনার পর থেকেই আত্মগোপনে আছেন।
এদিকে মিথ্যা আসামি হয়ে ফেঁসে যাওয়া নূরুল ইসলামের পরিবার ভীষণ দুর্দশায় পড়েছে। বড় ছেলে ১৮ বছর বয়সী সারোয়ার জাহান সজীব পড়ালেখার পাট চুকিয়ে কাঠমিস্ত্রির জোগালির কাজ নিয়েছে। আর তার দুই বছরের ছোট এমরান হোসেন কাজ করছে রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে। নূরুল ইসলামের স্ত্রী হোসনা বেগম বলেন, বিনা অপরাধে তার স্বামী জেল খাটছেন, সন্তানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার- পুলিশের ভুলে ওলটপালট হয়ে গেছে তার সংসার।
বিয়ানীবাজার থানার ওসি জুবের আহমদ পিপিএম বললেন, নূরুল ইসলাম যখন আটক হন তখন তিনি এ থানায় ছিলেন না। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তিনি দাবি করেন, পুলিশের এভাবে ভুল হওয়ার কথা নয়। বিভিন্নভাবে যাচাই-বাছাইয়ের পরই কোনো পলাতক আসামিকে শনাক্ত করা হয়ে থাকে। তিনি সন্দেহ করছেন, অন্য কোথাও, অন্য কোনো রহস্য রয়েছে এর পেছনে।-এমজমিন
২২ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ