আরাফাত মুন্না: সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর। ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলায় তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ওই রায় দেয়া হয়। একই রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় মুফতি হান্নানের দুই সহযোগী শরীফ শাহেদুল বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনকে। মুফতি হান্নান ও বিপুল কারাগারে আছেন। রিপন পলাতক। ওই দুজনের ডেথ রেফারেন্স বা মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণ অনুমোদনের বিষয়টি সাড়ে পাঁচ বছর ধরে শুনানির অপেক্ষায় ছিল হাইকোর্টে। সম্প্রতি হাইকোর্ট এদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেও আপীল শুনানির অপেক্ষায় আছে।
এদের মতো বিভিন্ন মামলায় আরও ২১ দুর্ধর্ষ জঙ্গীকে দেশের বিভিন্ন আদালত মৃত্যুদন্ডে- দন্ডিত করলেও ডেথ রেফারেন্স ও আপীল নিষ্পত্তি না হওয়ায় মৃত্যুদ- কার্যকর প্রক্রিয়া আটকে আছে। সরকারের জঙ্গী নির্মূলের ঘোষণা থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এসব ডেথ রেফারেন্স শুনানির বিশেষ কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে থাকা এসব জঙ্গী এখনও যোগাযোগ রেখে চলেছে বাইরে থাকা পলাতক জঙ্গীদের সঙ্গে। আর এ কারণে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গী জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন ও রাকিব হাসানকে কাশিমপুর কারাগার থেকে একটি মামলায় ময়মনসিংহের আদালতে নেয়ার সময় ফিল্মি স্টাইলে ছিনিয়ে নেয় সহযোগীরা। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে প্রায় ৪০টি এবং রাকিবের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০টি মামলা রয়েছে। সালাউদ্দিন তিনটি এবং রাকিব হাসান একটি মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি মামলায় ফাঁসি কার্যকর হলে এদের বিভিন্ন আদালতে হাজির করার প্রয়োজন হতো না। ফলে পালানোরও সুযোগ পেত না তারা।
মৃত্যুদ-প্রাপ্ত যেসব জঙ্গী কারাগারে: মুফতি হান্নান কাশিমপুর ২ নম্বর কারাগারে আছেন। তার বিরুদ্ধে ঢাকা, সিলেট, নোয়াখালী, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, হবিগঞ্জে মোট ৩৫টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় প্রায়ই তাকে কারাগার থেকে দেশের বিভিন্ন আদালতে হাজির করতে নিতে হয়। তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলারও আসামি। দেশের বিভিন্ন আদালতে তাকে নেয়ার কারণে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কয়েকবার পিছিয়ে দিতে হয়েছে বলে জানা গেছে।
রমনা বটমূলে বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত হুজি সদস্য আরিফ হাসান সুমনকেও মুফতি হান্নানের সঙ্গে গত বছর মৃত্যুদন্ড দেন ঢাকার আদালত। সুমন কাশিমপুর কারাগারে আছেন। ওই মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা এখনও পলাতক। গাজীপুর আদালতে বোমা হামলার দায়ে ২০১৩ সালের ২০ জুন ১০ জঙ্গীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪। এদের মধ্যে জেএমবি সদস্য মোঃ নিজাম উদ্দিন ওরফে রনি ওরফে রেজা, আরিফুর রহমান ওরফে হাসিব ওরফে আকাশ, সাউদুল মুন্সী ওরফে ইমন ওরফে পলাশ, মাসুদ ওরফে আনিসুল ইসলাম ওরফে ভুট্টু, আবদুল্লাহ আল সোয়াইল ওরফে ফারুক ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে আকাশ, এনায়েতুল্লাহ জুয়েল ওরফে ওয়ালিদ, তৈয়বুর রহমান ওরফে হাসান, মামুনুর রশিদ ওরফে জাহিদ, আশ্রাফুল ইসলাম ওরফে আব্বাস খান, আদনান সামী ও শফিউল্লাহ তারেক ওরফে আবুল কালাম কাশিমপুর কারাগারে আছে।
২০০৫ সালের বোমা হামলার ঘটনায় উদ্ভূত একটি হত্যা মামলায় লক্ষ্মীপুরের দায়রা জজ আদালত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন জেএমবির জঙ্গী আমজাদ হোসেন বাবু ও এইচএম মাসুমুর রহমানকে। ২০০৬ সালের ১৫ আগস্ট রায় দেয়া হলেও এখনও ডেথ রেফারেন্স শুনানি হয়নি হাইকোর্টে। একই বছরের বোমা হামলার ঘটনায় শরীয়তপুরের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসির নির্দেশ দেন কামারুজ্জামান ওরফে স্বপন নামের এক জঙ্গীকে।
২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সিলেটের দায়রা জজ ফাঁসির দণ্ড দেয় জঙ্গী আক্তারুজ্জামানকে। ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ মৃত্যুদ- দেয় জঙ্গী আসাদুজ্জামানকে। ২০১০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদ- হয়েছে জঙ্গী আবুল কালাম ওরফে শফিউল্লাহর। এরা সবাই গাজীপুর হাই সিকিউরিটি ও কাশিমপুর কারাগারে আছে। এই আসামিদেরও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয়নি এখনও।
পুলিশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রত্যেক আসামির বিরুদ্ধে এক থেকে ৪০টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে। সম্প্রতি পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তালিকা করে এদের ডেথ রেফারেন্স শুনানির ব্যবস্থা করতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, হাইকোর্টে কোন মামলা কোন বেঞ্চে শুনানি হবে তা নির্ধারণ করেন প্রধান বিচারপতি। তাই জঈদের মৃত্যুদন্ড- অনুমোদনের বিষয়ে বিচারাধীন ডেথ রেফারেন্স দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করা যায় কিনা সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার প্রধান বিচারপতিরই।
রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করার জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করা হবে কি-না, জানতে চাইলে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বিশেষ ব্যক্তির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। এভাবে বিশেষ বেঞ্চ গঠন করতে হলেতো সিভিল, রিটসহ অন্যান্য মামলার শুনানি বন্ধ করে দিতে হবে। জঙ্গীদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা বিচারাধীন, সেসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ চলমান রয়েছে বলেও জানান এ্যাটর্নি জেনারেল।
এ বিষয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিশেষ পিপি মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, অবশ্যই দ্রুত ডেথ রেফারেন্সগুলো নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আরও যেসব মামলা বিচারাধীন, সেসব মামলা নিষ্পত্তিতেও সুবিধা হয়। তিনি আরও বলেন, কোন জঙ্গীর ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির মাধ্যমে যদি দ- কার্যকর করা হয়, তাহলে আর অন্য মামলাগুলোতে আদালতে হাজির করার প্রয়োজন হবে না।
আইনজীবী ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, জঙ্গী নির্মূলের জন্য মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। তারা ভয়ঙ্কর অপরাধী। কিছু জঙ্গীর ফাঁসি কার্যকর হলে, নতুন যারা জঙ্গীবাদে ঝুঁকছে তারা ভয় পাবে।-জনকন্ঠ
১৪ জুলাই, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ