আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতের উত্তর প্রদেশে গরুর মাংস খাওয়ার গুজবে এক মুসলমানকে হত্যার পর প্রশ্ন উঠেছে, সেখানে নতুন কোন ‘মুজাফফরনগর’র বাস্তবতা তৈরী হবে কিনা। শুধ উত্তর প্রদেশ নয়, রাজধানী দিল্লীর আশেপাশের রাজ্যগুলোতে একই উদ্বেগ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মুজাফফর নগরের ধারাবিাহিকতায় গুজব-হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি-ঘৃণা ছড়ানোর কায়দা দেখেই এমনটা মনে করছেন সবাই।
২০১৩ সালে মাজাফফরনগরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় বহু হতাহত হয়। এ ঘটনায় উদ্বাস্তুহয়েছেন অন্তত ৪০ হাজার মানুষ। কিন্তু ২০১৪ সালে সেখান থেকে বিপুল জয় পায় ভারতের বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিজেপি। লোকসভার ৮০ টি আসনের মধ্যে ৭৩ টিতেই জয় লাভ করে বিজেপি। এ ধরণের ঘটনা আর ঘটবে না এমন আশ্বাস দিয়েছিলো রাজনৈতিক দলগুলো।
এ সোমবার উত্তর প্রদেশের একটি গ্রামে গরুর মাংস খেয়েছেন, এমন এ গুজবে ৫৮ বছয় বয়সী আখলাক নামে এক মুসলমানকে হত্যা করেছে হিন্দুরা। অগের যাবতীয় আশ্বাসগুলো যে ভুয়া ও অসাড় ছিলো, এ ঘটনা তাই প্রমাণ করে। গৌতম বুদ্ধ নগরের ম্যাজিষ্ট্রেট এনপি সিং জানিয়েছেন, রাজ্যের পশু বিশেষজ্ঞরা নিহত আখলাকের বাড়ি থেকে কথিত সে গরুর মাংসের নমুনা পরীক্ষা করে দেখেছেন। সেগুলো আসলে গরুর মাংসই নয়।
এ ঘটনার পর উত্তর প্রদেশের ওই গ্রামের মুসমলমানদের মধ্যে তীব্র শঙ্কা আর আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমনকি গ্রাম ছেড়ে চলে যেতেও চাইছেন তারা। তবে প্রশাসনের আশ্বাসে আপাতত গ্রাম না ছাড়লেও আতঙ্ক এখনো কাটেনি তাদের। ম্যাজিষ্টেট এনপি সিংও মনে করেন, এ ঘটনা থকে যদি মুজাফফরনগরের মত কোন ঘটনা ঘটে, তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মাত্র দু বছর আগে এ প্রদেশেরই মুজাফফরনগরে হিন্দতু-মুসলিম এক দাঙ্গায় অন্তত ৬২ জন নিহত হন, বাস্তুচ্যুত হন প্রায় ৫৫ হাজার।
এসপি সিং জানিয়েছেন, সোমবারের ঘটনায় অভিযুক্ত দশজনের মধ্যে সাত জনকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রথমিকভাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সাথে এদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। অভিযুক্তদের সবার বয়সই ২০-২৫ এর মধ্যে। গ্রেফতারকুতদের মধ্যে এমন দু জন আছে, যারা মূলত হামলার জন্য মানুষজন যোগাড় করেছেন। তারা নিকটস্থ একটি মন্দিরে গিয়ে মানুষজনকে জড়ো করেন এবং আখলাকের ঘরে গরুর মাংস পাওয়া গেছে বলে তাদেরকে জানান। এরপর মানুষ আখলাকের ঘরে সমন্বিতভাবে হামলা চালায়। তার বাড়িঘর ভাঙচুর করে এবং তাকে হত্যা করে।
জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এনপি সিংকে যে জিনিসটি বিষ্মিত করেছে সেটা হচ্ছে, গ্রামের অধিকাংশ মানুষই আখলাকের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করতেন। তাকে নিরপরাধ ও নিরীহ কামার হিসেবেই জানতের গ্রামের মানুষজন। এনপি সিং বলেন, আমি গ্রামবাসীদের উভয় পক্ষের গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার বিষয়ে অবহিত করেছি। কারণ তারা যেভাবে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিলো, তাতে ভয়াবহ কিছু ঘটার ইঙ্গিত ছিলো স্পষ্ট। আশেপাশের গ্রামগুলোর মানুষজনের জড়ো হওয়া ঠেকাতে আমরা ২৪ ঘন্টা পর্যবেক্ষণের ব্যাবস্থা নিয়েছি। যাতে গুজবের ভিত্তিতে এ ধরণের হত্যাকান্ড আর না ঘটে। এছাড়া এ ঘটনায় বিজেপির কিছু নেতা ‘গোহত্যা আইন অমান্য হয়েছে’ বলে যে দাবি করছেন, তাতেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে।
যেভাবেই হোক, মুজাফফর নগরের ধারাবাহিকতায় এ জঘন্য ঘটনা থেকেও রাজনৈতিক ফায়দা লোটার লোভ সামলাতে পারেনি বিজেপি। দলটির কিছু নেতা নিহত আখলাককে ‘গো হজত্যাকারী’ হিসেবে বর্ণনা করে উগ্র হিন্দুবাদীতের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে প্রদেশটিতে গো হত্যা নিষিদ্ধ আছে। যদিও আগের আইনে ১৫ বা তার বেশি বয়সী গরু বা মহিষ জবাইয়ে কোন বাধা ছিলো না।
এমনকি যখন উত্তর প্রদেশে গরু জবাই ও এর মাংস বিক্রিতে আইনি কোন বাধা ছিলো না, তখনও এ প্রদেশে গরু জবাই ও মাংস বিক্তিতে বাধা দেয়া হতো। প্রদেশটির একজন শীর্ষস্থানীয় পশু বিশেষজ্ঞ বলেন, তখন গো হত্যা প্রতিরোধথক আইন ১৯৯৫ সংশোধন করা হয়। যেখানে অদুগ্ধবতী গরু, বয়স্ক মহিষ এবং কৃষিকাজে ব্যাবহার করা হয়নি এমন গরু বা মহিষ জবাইকে কোন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি। তখন ৩৮ টি জবাই খানারকে লাআসেন্স দেয়া হয়েছিলো যারা মহিষের মাংস রপ্তানি করত।
পরবর্তীকালে প্রাকৃতিকভাবে মারা যেতে পারে এমন গরু ও মহিষকে উত্তর প্রদেশের ৭৫ টি জেলায় বিশেষভাবে তৈরী ‘গোশালাস’ এ রাখা হত। এ কর্মকর্তা বলেন, রাজ্যের গরু ও মহিষকে টিকা দেয়ার সময় একটি সমীক্ষা চালানো হয়। দেখা গেছে রাজ্যে এক কোটি ৮৯ লক্ষ গরু আছে যাদের মধ্যে অদুগ্ধবতী ৪০ হাজার গরু রাজ্যের ৪৮৮ টি গোশালায় আছে।
গো হত্যা নিধন আইন ১৯৯৫ যখন প্রনয়ণ করা হয়েছিলো, তখন উত্তর প্রদেশের ক্ষমতায় ছিলো বিজেপি। এখন বিজেপি নেতারাই এটিকে আইনের বরখেলাপ’ বলে ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে চাইছে। অথচ তারা বারবার একটি বিষয় উপেক্ষা করে যাচ্ছেন যে, গরীব আখলাকের ফ্রিজে যদি কোন মাংস পাওয়াই যায়, তাহলে সেটা মহিষের মাংসই হবে। কারণ মহিষের মাংষই রাজ্যে কোন অাইনগড়ত বাধা ছাড়াই বিক্রি হতে পারে।
উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা এখন কারো ফ্রিজে কী থাকবে বা কারো ডাইনিং টেবিলে কি পরিবেশন করা হবে, তাও ঠিক করে দিতে চাচ্ছে।
এইসব মিলেই প্রশ্ন উঠেছে, এখানে কি আরেক মুজাফফরনগর ঘটছে।-প্রিয় নিউজ
সূত্র: ডেইলি
১ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ