আন্তর্জাতিক ডেস্ক: টুইন টাওয়ার হামলার ১৫ বছর পর এসেও ওইদিনের ভয়াবহতাকে এখনও শরীরে বয়ে নিয়ে চলেছেন হামলায় বেঁচে যাওয়া মার্কিনিরা। লড়ে যাচ্ছেন জীবনের তাগিদে। কেউ ক্যান্সারের ঝুকিঁ বয়ে বেড়াচ্ছেন, কেউবা আবার ভুগছেন হামলার স্মৃতিজনিত মানসিক যন্ত্রণায়। কেউ চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, কেউ পড়েছেন মাদকাসক্তিতে।
এদিকে, হামলার ১৫তম বর্ষপূর্তির ঠিক কয়েক মুহূর্ত আগে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের তরফ থেকে এ ঘটনার বিপরীতে আরেক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। ঘটনার শিকার হওয়া মানুষদের সৌদি নাগরিকদের বিরুদ্ধে মামলা করার অধিকারের পক্ষে একটি বিল পাস করে প্রতিনিধি পরিষদ। তবে বারাক ওবামা এই বিলে ভেটো দেওয়ার হুশিঁয়ারি দিয়েছেন।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ ১৫ বছর আগে ঠিক এই দিনেই যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে এক যোগে চালানো হয়েছিল চার-চারটি আত্মঘাতী বিমান হামলা। দুটি বিমান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের উত্তর ও দক্ষিণ টাওয়ারে আঘাত হানে। নিমেষে ধসে পড়ে ভবন দুটি। আরেকটি বিমান নিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনে হামলা চালায় জঙ্গিরা।
তবে চতুর্থ বিমানটি নিয়ে জঙ্গিরা পূর্ব নির্ধারিত স্থানে হামলা চালাতে চাইলেও যাত্রীদের প্রতিরোধের মুখে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পেনসিলভেনিয়ার আকাশে বিধ্বস্ত হয় সেই বিমান। হামলায় নিহত হন প্রায় ৩ হাজার মানুষ। ঘটনাস্থল থেকে ৭০ হাজার মানুষকে জীবিত উদ্ধারের তথ্য লিপিবদ্ধ করে মার্কিন স্বাস্থ্যবিভাগ।
হামলার ১৫ তম বর্ষপূর্তিতে এসে শুক্রবার দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার হেলথ রেজিস্ট্রি থেকে দেখা গেছে, ৯/১১ এর বেঁচে যাওয়া মানুষদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক ও মানসিক প্রভাব কাজ করছে। ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৯/১১ এর উদ্ধারকর্মীদের নিবন্ধিত ৭১ হাজার নাম রয়েছে, যাদের জীবিত উদ্ধার করা গিয়েছে। জানা গেছে, এই উদ্ধারকর্মীদের মধ্যে শতকরা ১১ ভাগই ক্যান্সারের ঝুঁকিতে রয়েছেন।
নিউ ইয়র্কের সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের বেঁচে যাওয়া মানুষের মধ্যে এই হার ৮ শতাংশ। উদ্ধারকর্মীদের মধ্যে প্রোস্টেট ও থাইরয়েড ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে উদ্ধারকৃতদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে স্তন ক্যান্সার ও নন-হগকিন লিমফোমার হার বেশি। এ ছাড়া তারা দ্রুত কর্মজীবন থেকে অবসর নিচ্ছেন, অনেকক্ষেত্রে চাকরিচ্যুতও হচ্ছেন। অনেকে স্মৃতিজনিত মানসিক যন্ত্রণা কিংবা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারেও ভুগছেন।
অন্য এক জরিপে দেখা যায়, ঘটনার ১০ বছর পর উদ্ধারকারী ও উদ্ধারকৃত মিলিয়ে সবার মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশই পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার বা পিটিএসডিতে ভুগছেন, ও ৫০ শতাংশই মদ্যপ হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া ধ্বংসস্তুপ পরিষ্কার করার সময় উপস্থিতদের মধ্যে ৫ দশমিক ৪ শতাংশের মধ্যেই অ্যাজমার ঝুঁকি দেখা গিয়েছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ডেইলি নিউজের এক প্রতিবেদনে খুবই সাম্প্রতিক এক গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ের মুখে রয়েছেন ৯/১১ হামলায় বেঁচে যাওয়া মানুষেরা।
২০০১ সালের ওই দিনে চারটি মার্কিন যাত্রিবাহী বিমান ছিনতাই করে নিউ ইয়র্কের স্থানীয় সময় ৯টার দিকে চালানো হয় এই হামলা। পরিকল্পিতভাবে চালানো নারকীয় এ ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞের জন্য ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদাকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিভাগ। ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে আত্মগোপন করে থাকা লাদেনকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ বাহিনী ‘নেভি সিল'।
পরে দেখা যায়, এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজন ১৯ জনের মধ্যে ১৫ জনই সৌদি নাগরিক। তবে সৌদি আরব প্রথম থেকেই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। মাস দুয়েক আগে মার্কিন কংগ্রেস এ সংক্রান্ত ২৮ পৃষ্ঠার গোপন নথি প্রকাশ করেছে যেখানে ৯/১১ হামলাকারী কয়েকজনের সঙ্গে সৌদি সরকারের কর্মকর্তাদের যোগাযোগ ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কেবল তাই নয়, এই হামলার পরিকল্পনাকারীদের একজন জাকারিয়া মুসাবি বর্তমানে মার্কিন কারাগারে রয়েছেন। গত বছর তিনি স্বীকার করেছেন একজন সৌদি প্রিন্স এ হামলায় অর্থায়ন করেছিলেন। ঘনিষ্ঠ মার্কিন-সৌদি পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবতায় তাই দুনিয়াজুড়ে প্রশ্ন ওঠে, আসলে কি যুক্তরাষ্ট্র আড়াল করার চেষ্টা করছে দোষীদের?
এই প্রেক্ষাপটেই, হামলার ১৫তম বর্ষপূর্তির এক দিন আগে নাইন ইলেভেনের ঘটনায় সৌদি সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুযোগ রেখে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে (হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ) একটি বিল পাস হলো। শুক্রবার বিলটি সর্বসম্মতিক্রমে কণ্ঠভোটে পাস হয়।
এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সমর্থন লাভ সাপেক্ষে ৯/১১ এর ঘটনায় সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে ক্ষতিগ্রস্তরা। তবে বারাক ওবামা ওই আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন শুরু থেকেই। শুক্রবার প্রতিনিধি পরিষদে তা পাস হওয়ার পর ভেটোর হুমকিও দিয়েছেন তিনি।
তবে হামলার ১৫তম বর্ষপূর্তিতে এসে মার্কিনিদের তরফ থেকে জোরেশোরেই বিচারের দাবিটি তোলা হয়েছে। প্রতিনিধি পরিষদে পাস হওয়া মামলার অধিকার সংক্রান্ত বিল এখন ওবামার কাছে আসবে। তিনি কী করবেন, হামলার শিকার হওয়া বিচারপ্রার্থীদের পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব শেষ পর্যন্ত তিনিই কষবেন।
তবে রাজনীতি বিশ্লেষকরা সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আশঙ্কা করেছেন, কোনওভাবেই এই সম্পর্ক নষ্ট হতে দেবে না মার্কিন প্রধান দুই রাজনৈতিক দল। কেননা উভয় দলই পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে সৌদি আারবকে ঘনিষ্ঠ সহচর মনে করে থাকে।-বাংলাট্রিবিউন
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সবুজ/এসএ