তরিকুর রহমান সজীব : হিলারি ক্লিনটন নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প- কে হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উত্তরসূরি? জনমত জরিপে হিলারি শেষ পর্যন্ত এগিয়ে থাকলেও পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাবনাও কেউ উড়িয়ে দিতে পারছেন না।
রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প সর্বশেষ নির্বাচনী প্রচারণাগুলোতেও আত্মবিশ্বাসী হিসেবেই হাজির হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনিই প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলে সেটা কেমন হবে বিশ্বের জন্য? নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই ট্রাম্প নানা ইস্যুতে বিতর্ক তৈরি করেছেন। তিনি নির্বাচিত হলে তাই অনেকেই আশঙ্কা করছেন, সেটা বিশ্বের জন্য সুখকর হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য- এমন নানা ইস্যুতে ট্রাম্পের বক্তব্যগুলো এই আশঙ্কার কারণ।
চূড়ান্ত ভোটে বিজয়ী হতে পারলে ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন ২০শে জানুয়ারি। বৃটেনের দ্য টাইমস লিখেছে, এরপর ট্রাম্পের প্রথম পদক্ষেপ হবে ‘ওবামার প্রেসিডেন্সিকে মুছে ফেলা’। এর জন্য হয়তো তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানা ধরনের নথিপত্রকে স্বাক্ষর করতে হবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারলে ট্রাম্প তার প্রথম একশ’ দিনের কর্মপরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন।
তার বাস্তবায়ন শুরু হলে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের কর্পোরেট লবিয়িস্ট হওয়া বন্ধ করবেন তিনি। প্রথম একশ’ দিনের মধ্যেই জলবায়ু তহবিলে সব ধরনের মার্কিন অনুদান বন্ধ করে দিবেন। এটা প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করার সূচনামাত্র, যা গোটা বিশ্বের জলবায়ু পরিস্থিতিতেই নেতিবাচক প্রভাব রাখবে।
ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার বক্তব্য ও নানা ধরনের বাগাড়ম্বরে আস্থা রাখলে তাকে নিয়ে আশঙ্কার অনেক কারণই রয়েছে। সেটা খোদ মার্কিনিদের জন্য যেমন প্রযোজ্য, গোটা বিশ্বের জন্যও প্রযোজ্য। মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য তাকে অনেক বেশি বিতর্কিত করেছে।
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে আমেরিকায় মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিবেন। পরে আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, যেসব মুসলিম দেশে সন্ত্রাসবাদ রয়েছে, সেসব দেশ থেকে কোনোভাবেই মুসলিমদের প্রবেশ করতে দেবেন না আমেরিকায়। মুসলিম মানেই সন্ত্রাসী, এমন সুরও পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে তার বক্তব্যে। সত্যি সত্যিই তাই ট্রাম্প মুসলিমদের আমেরিকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার পথে হাঁটলে সেটা মুসলিমবিদ্বেষকে আরো উস্কে দেবে।
ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশেই ডানপন্থি দলগুলো এখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছে। ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বেষ বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করলে তা গোটা মুসলিম বিশ্বেই অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে দেবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো যে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রয়েছে সেই পরিস্থিতিতেও তা আগুনে ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতি উদ্রেক করবে।
প্রেসিডেন্ট হতে পারলে আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প। তবে এর কোনো বিস্তারিত পরিকল্পনা ঘোষণা করেননি তিনি। তবে ‘জিহাদি দলগুলো’ ওপর বোমা বর্ষণের হুমকি দিয়েছেন তিনি।
বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে আরো ৩০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করবেন। রাশিয়াকেও ওই অঞ্চলে আরো বেশি প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ দেবেন বলে জানিয়েছেন। এখন পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পক্ষে শক্ত অবস্থান রয়েছে রাশিয়ার। এর বিপরীতে অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের। সে ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে তিনি সিরিয়াতে কি রাশিয়ার মতোই বাশারের পক্ষ অবলম্বন করবেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়।
আর আইসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে হাত মেলাবেন কিনা, সেটাও বড় একটি প্রশ্ন। আইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া একজোট হয়ে অভিযান শুরু করতে পারলে তা নতুন এক দিগন্তের সূচনা করবে। সিরিয়ার মতো মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে থাকা ইয়েমেন, লিবিয়া, ইরাকের মতো দেশগুলো নিয়েও ট্রাম্পের অবস্থান পরিষ্কার নয়। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ৩০ হাজার সৈন্য মোতায়েনের কথা বলেছেন ঠিকই, বিপরীতে ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের কথাও ইঙ্গিতে বলেছেন। এমন ধোঁয়াশাপূর্ণ বক্তব্যে তাই ট্রাম্প নিয়ে শঙ্কা আরো ঘনীভূত হয়েছে।
অভিবাসন ইস্যুতে ট্রাম্পের অবস্থান নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। তিনি অবৈধ অভিবাসীদের আমেরিকা থেকে বিতাড়িত করার কথা বলেছেন। এরপর বেশ কয়েকটি বক্তব্যে তিনি একবার কথা বলেছেন নরম সুরে, পরের বারই কঠিন সুরে। এ ইস্যুতে তার সর্বশেষ অবস্থান হলো- অবৈধ বা অনথিভুক্ত অভিবাসীদের তাৎক্ষণিকভাবে বিতাড়িত করার পদক্ষেপ নেবেন তিনি। পাশাপাশি অভিবাসন আইনকে কঠোর করবেন। সীমান্তকেও করবেন সুরক্ষিত।
এরপরই বাকি অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন তিনি। তার নিজের হিসাবেই এক কোটিরও বেশি মার্কিন অভিবাসীর নেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে এই বিপুল পরিমাণ মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হলে তা একদিকে যেমন মার্কিন শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তেমনি ওইসব অভিবাসী নিজেদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আর ভিনদেশিদের নিয়ে মার্কিনিদের এমন অসহিষ্ণু প্রবণতা সারা বিশ্বকেও নেতিবাচক বার্তাই প্রদান করবে।
ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় বারবার বলেছেন, মেক্সিকোর সীমান্তে দেয়াল তোলার কথা। এই দেয়াল নির্মাণের টাকাও মেক্সিকোর কাছ থেকে নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এক হাজার মাইল সীমান্তজুড়ে এমন একটি দেয়াল তোলাটা বাস্তবসম্মত নয়। আবার এই দেয়াল তোলার টাকা মেক্সিকো দিবে, তেমন সম্ভাবনাও নেই। সে ক্ষেত্রে ট্রাম্প এই দেয়াল তোলার জন্য দ্বারস্থ হতে পারেন কংগ্রেসে। সেখানেও তার পক্ষে অনুমোদন আসবে- এমন সম্ভাবনাও নেই। বাস্তবসম্মত চিত্র হতে পারে, মেক্সিকো সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ট্রাম্প প্রেসিডেন্সির প্রভাব নিয়েও শঙ্কা কম নেই। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে মার্কিন কোম্পানিগুলোকে বহির্বিশ্বে কারখানা স্থাপন বন্ধ করতে হবে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক নিয়ে তিনি নেতিবাচক কথা বলেছেন। চীনা পণ্যে বাড়তি কর আরোপের পরিকল্পনা জানিয়েছেন। ডব্লিউটিও থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন। ঘোষণা দিয়েছেন নাফটা চুক্তি থেকে আমেরিকার নাম প্রত্যাহার করে নেয়ার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এসব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন বাণিজ্যযুদ্ধের শামিল। এসব পদক্ষেপ তাই আলোর মুখ দেখতে থাকলে তা আমেরিকার নিজস্ব অর্থনীতি তো বটেই, গোটা বিশ্বের অর্থনীতির ভবিষ্যৎকেই হুমকির মুখে ফেলবে। একদিকে ব্রেক্সিটের ফল হিসেবে বৃটেনসহ ইউরোপের অর্থনীতি রয়েছে চাপের মুখে। তার প্রভাব এশিয়াসহ বাকি বিশ্বেও পড়ছে। এর সঙ্গে ট্রাম্পের বাণিজ্য পরিকল্পনা গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ও বাণিজ্যে দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
নিরাপত্তা ইস্যুতেও ট্রাম্পের অবস্থান নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো আক্রান্ত হলে স্বাভাবিকভাবেই জোটের অন্য সদস্য দেশগুলোর ওই দেশের সহায়তায় এগিয়ে আসার কথা। এই রীতিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন ট্রাম্প। বলেছেন, ন্যাটোতে সবাই অর্থ জোগান না দিলে তিনি জোটভুক্ত দেশের সহায়তায় এগিয়ে আসবেন না। রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির সীমান্তবর্তী ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতে এরই মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়ে ন্যাটোর মিত্র দেশগুলোর থেকে সমর্থন তুলে নিলে তা আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে নতুন উত্তেজনা তৈরি করবে। একই কথা প্রযোজ্য দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতেও।
এখন পর্যন্ত এখানে স্পষ্টত চীনের বিরোধিতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ট্রাম্প আবার জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে আসার বিপক্ষে অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। চীনের প্রতি বাণিজ্য নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থানও বিরোধপূর্ণ। একই এলাকা ফিলিপাইনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। দক্ষিণ চীন সাগরের বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে তাই প্রেসিডেন্ট হলে ট্রাম্প নতুন মেরুকরণ তৈরি করতে পারে।
উত্তর কোরিয়ার প্রতি আবার নরম সুর দেখিয়েছেন ট্রাম্প। দেশটির নেতা কিম জং উনের সঙ্গে বৈঠকের আগ্রহের কথাও জানিয়েছেন। ভাবী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এমন নরম আচরণ সাম্প্রতিক সময়ে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা চালানো উত্তর কোরিয়াকে প্রশ্রয় দিতে পারে, এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। সেটা গোটা বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলোর মধ্যেই নতুন উত্তেজনা তৈরি করতে পারে।
ট্রাম্প তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের স্লোগান রেখেছেন ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’। তিনি তার নির্বাচনী প্রচারণায় একাধিকবার বলেছেন, আমেরিকার নিজস্ব অনেক সমস্যা রয়েছে। এগুলোকে ঠিকঠাক না করে বিশ্ব নিয়ে মাথা ঘামাতে তিনি খুব বেশি আগ্রহী নন। কিন্তু আমেরিকার সেই অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সঙ্গে বিশ্বও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারলে আমেরিকাকে ‘গ্রেট’ করার দিকে মনোযোগী হলেও তার প্রভাব বিশ্ব এড়াতে পারবে না।
আর সেই প্রভাবের কেন্দ্রে থাকতে পারে মুসলিমবিদ্বেষ, আঞ্চলিক উত্তেজনা, বিশ্ব অর্থনীতিতে ধস, দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবনতি, জলবায়ু পরিস্থিতি উত্তরণে পিছিয়ে আসা এবং চূড়ান্ত বিচারে বিশ্ব নিরাপত্তায় হুমকি। আর সে কারণেই হয়তো মার্কিনিদের মধ্যে ট্রাম্প-হিলারি লড়াই হাড্ডাহাড্ডি হলেও বেশিরভাগ দেশেই ট্রাম্পের পক্ষে সমর্থনের উদাহরণ কম।
ইউগভের সর্বশেষ জরিপেও তারই প্রতিফলন দেখা যায়। জার্মানি, ফ্রান্স, বৃটেন, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও নরওয়েতে পরিচালিত তাদের জরিপে বেশিরভাগের মতামত- হিলারি প্রেসিডেন্ট হলে হবেন গড় মানের। আর ট্রাম্প হবেন ‘ভয়ানক’ এক প্রেসিডেন্ট। এমজমিন
সূত্র: টাইমস, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ফোর্বস, বিবিসি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট
৮ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি