শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:২৯:১৬

যেমনটা কাটছে তাজিকিস্তানের মুসলমানদের দিনকাল

যেমনটা কাটছে তাজিকিস্তানের মুসলমানদের দিনকাল

মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা: তাজিকিস্তানের বেশির ভাগ জনগণ তাজিক জাতির লোক। তাই এটি ‘তাজিকিস্তান’—অর্থাৎ তাজিক জাতির আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। এখানকার লোকেরা তাজিক নামের একটি ফারসি জাতীয় ভাষায় কথা বলে। জনসংখ্যা ৭৭,৬৮,৩৮৫ জন। ২০০৯ সালের মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের হিসাব মতে, দেশটির জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ মুসলমান, যাদের ৯৫ শতাংশ সুন্নি ও ৩ শতাংশ শিয়া। এ ছাড়া রয়েছে কিছু সুফিবাদী। সুন্নিদের বেশির ভাগই হানাফি মাজহাবের অনুসারী।

তাজিকিস্তান দক্ষিণ-পূর্ব মধ্য এশিয়ার একটি স্থলবেষ্টিত প্রজাতন্ত্র। এর উত্তরে রয়েছে কিরঘিজস্তান, উত্তর ও পশ্চিমে উজবেকিস্তান, পূর্বে গণচীন ও দক্ষিণে আফগানিস্তান। এখানকার রাজধানী দেশের বৃহত্তম শহর দুশানবে এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হচ্ছে খুজন্দ। যেখানে অনেক বড় বড় আলেম ও ওলির জন্ম হয়েছে। আল্লামা রুমি (রহ.)-এর শায়খ খাজা শামসুদ্দীন তিবরিজের আধ্যাত্মিক গুরু কামালুদ্দিন খুজন্দি (রহ.)ও এখানকার সন্তান বলে ধারণা করা হয়। এটি ‘মা-ওয়ারাউন নহর’-এর বিস্তীর্ণ এলাকার একটি অংশ ছিল। একসময় উজবেকিস্তান, কিরঘিজস্তান ও তাজিকিস্তানের পুরো এলাকা একসঙ্গে ছিল। হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দীতে মুসলমানরা এই অঞ্চল জয় করে নেয়। পরে ১৮৬৮ সালে রুশ বাহিনী বুখারা আমিরাতকে পরাস্ত করার মাধ্যমে এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এর ফলে তাত্ত্বিক দর্শনের ভিত্তিতে প্রথম বাস্তব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সৃষ্টি হয় ১৯১৮ সালে। যার প্রতিবাদে বুখারার ইব্রাহিম বেগের নেতৃত্বে মুসলমানরা ১৯৩১ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৩১ সালে তাজিকিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি অংশে পরিণত হয়।

এ অঞ্চলের মুসলমানরা আগে থেকেই রুশদের নির্যাতনে জর্জরিত ছিল; কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর নির্যাতনের মাত্রা তুঙ্গে পৌঁছে যায়। সব মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হয়, নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করা হয়। দ্বীনি শিক্ষা তো দূরের কথা, কোরআন শরিফ নিজের কাছে রাখাও সে যুগে অপরাধ বলে সাব্যস্ত করা হতো। কোনো আলেম প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেই তাঁকে অত্যন্ত ভয়ংকর মৃত্যুর মুখে পড়তে হতো। প্রায় ৭৪ বছর মুসলমানরা কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পার করেছে, কিন্তু সেখানকার ওলামায়ে কেরাম এত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্য নজিরবিহীন ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁরা লুকিয়ে লুকিয়ে নামাজ আদায় করতেন, দ্বীনি শিক্ষা দিতেন। গভীর রাতে যখন মানুষ স্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করত, তাঁদের কামরা তখন দ্বীনি ইলমের আলোয় আলোকিত হয়ে থাকত। তাঁরা আরামের ঘুম বিসর্জন দিয়ে  ছাত্রদের ইলম শিক্ষা দিতেন। যার ফলে ৭৪ বছর নির্যাতনের চাকায় পিষ্ট হয়েও তাঁরা নিজেদের ইমান-আমল ঠিক রেখেছিলেন।

অবশেষে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্যদিয়ে এটি স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার ঠিক পরপরই দেশটিতে সাম্যবাদী সরকার ও ইসলামপন্থাবিরোধী দলগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের জুন মাসে দুই পক্ষ একটি শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে।

বর্তমান অবস্থা : তাজিকিস্তানের জনগণ ধর্মভীরু। তাঁরা নিজেদের মতো করে ধর্মচর্চা করে থাকেন। বিশেষ করে পাশে আফগানিস্তান থাকায় সেখানকার ভাবধারায় প্রভাবান্বিত হয়ে ধর্মচর্চার প্রভাব অত্যধিক। বহু পবিবারের শিশু বিদেশে, বিশেষ করে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে গিয়ে মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করে। কিন্তু সে দেশের সরকারের জন্য এটা বিব্রতকর। পশ্চিমা ধাঁচের সরকার অন্য সব দেশের মতো সেখানেও জঙ্গি তালাশ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। প্রেসিডেন্ট ইমোমালি রাহমন দেশের জনগণকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের পড়ালেখা না করানোর জন্য পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, এর ফলে ভবিষ্যতে সন্তানরা সন্ত্রাসী হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এর আগে ২০০৫ সালে দেশটির সেক্যুলার স্কুলগুলোয় মেয়েদের হিজাব পরিধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু দেশটির মহিলারা নিজেদের ঐতিহ্য হিসেবেই হিজাব পরে থাকেন। কিছু ক্ষেত্রে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও তাজিকিস্তান সরকারের কিছু উদ্যোগ বিশ্বের মুসলিমদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—তাজিক সরকার ২০০৯ সালকে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বর্ষ হিসেবে পালন করেছে। সে বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আলেম ও ইসলামী চিন্তাবিদদের আমন্ত্রণ জানানো হয় একটি আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামে। ২০১০ সালে বিশ্ব ইসলামী সংস্থা ওআইসির একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে। এতে বিশ্বের ৫৬টি মুসলিম দেশের প্রতিনিধিরা যোগদান করেন। বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে রাজধানী দুশানবে। কাতারের অর্থায়নে এ মসজিদের নির্মাণকাজ ২০০৯ সাল থেকে চলে আসছে। এ ছাড়া গত বছর তাজিকিস্তানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের হাই স্কুলগুলোতে ইসলামী ইতিহাস যোগ করার ঘোষণা দিয়েছে, যা এ বছর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক
২৫ নভেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে