আন্তর্জাতিক ডেস্ক: গত শতকের আশির দশকে মস্কোতে নির্মাণ করা হচ্ছিল বিশাল এক মার্কিন দূতাবাস। কিন্তু এই নির্মাণাধীন ভবনে সোভিয়েতরা গোপনে অত্যাধুনিক সব আড়িপাতা যন্ত্র স্থাপন করেছে বলে অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্র।
এ নিয়ে দুদেশের মধ্যে শুরু হয়েছিল তীব্র কূটনৈতিক বিতন্ডা।
যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। মস্কোতে প্রায় দুশো মিলিয়ন ডলার খরচ করে তৈরি করা হচ্ছে নতুন মার্কিন দূতাবাস।
কিন্তু হঠাৎ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগ্যান ঘোষণা করলেন, এই ভবনটি তাদের ভেঙ্গে ফেলতে হতে পারে। কারণ বিশাল এই ভবনের পরতে পরতে নাকি সোভিয়েতরা আড়ি পাতা যন্ত্র বসিয়ে রেখেছে।
মস্কোতে যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন দূতাবাস ভবনটি হতে যাচ্ছে সেসময় বিশ্বের সবচেয়ে বড়, আধুনিক এবং ব্যয়বহুল দূতাবাস। কিন্তু মার্কিনীদের অভিযোগ, অর্ধনির্মিত দূতাবাস ভবনটি ইতোমধ্যে গোপনে ইলেকট্রনিক আড়ি পাতা যন্ত্র দিয়ে ভরে ফেলেছে সোভিয়েতরা।
নতুন এই ভবনকে যুক্তরাষ্ট্র তখন তাদের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তার জন্য এক বিরাট হুমকি হিসেবে দেখছে। থমাস জেনড্রাইসিক তখন মস্কোর মার্কিন দূতাবাসে দুবছর প্রধান নিরাপত্তা প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন।
"খুবই কঠিন একটা সময় ছিল সেটা। একটা সময় তো বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে আমাদের কোন ইলেকট্ট্রনিক কম্যুনিকেশন ছিল না। তখন আমাদের সমস্ত কিছু হাতে লিখতে হতো। এসব চিঠি নিয়ে পত্রবাহকরা উড়ে যেতেন জার্মানিতে। তো সেই সময়ে আমাদেরকে এভাবে হাতে লেখা চিঠি দিয়েই যোগাযোগ রক্ষা করতে হতো। পুরো দূতাবাসে তখন কেবল ছোট্ট কয়েকটি রুম ছিল, যেগুলোকে আমরা মোটামুটি নিরাপদ মনে করতাম, সেগুলোতেই কেবল আড়িপাতা যন্ত্রের ভয় ছাড়া কথা বলা যেতো।"
মস্কোর পুরোনো মার্কিন দূতাবাস ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। কিন্তু ১৯৭০ এর দশকে এসে এটি আর যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশের দূতাবাসের কাজ চালানোর অনুপযোগী হয়ে পড়লো।
স্নায়ুযুদ্ধের পটভূমিতে যে বিরাট প্রযুক্তিগত অগ্রগতি হয়েছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি নতুন অত্যাধুনিক দূতাবাস ভবন দরকার যুক্তরাষ্ট্রের। ১৯৭৯ সালে নতুন দূতাবাস ভবনের কাজ শুরু হলো। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটা চুক্তিও হলো।
"রাশিয়ানরা ওয়াশিংটনে একটা নতুন দূতাবাস ভবন তৈরি করছিল। আর আমরাও একই সময়ে মস্কোতে আমাদের নতুন দূতাবাস নির্মাণ করছিলাম। দুই দেশের মধ্যে যে চু্ক্তি হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, রাশিয়ানরা তাদের ওয়াশিংটনের দূতাবাসের জন্য স্থানীয় ঠিকাদার ব্যবহার করবে।
একইভাবে আমরাও মস্কোতে রাশিয়ান ঠিকাদার ব্যবহার করবো, তবে তারা কাজ করবে আমাদের তদারকীতে। এই দূতাবাস ভবনের অনেক নির্মাণ সামগ্রী আমরাই সরবরাহ করতাম। যেমন ধরুণ, দূতাবাস ভবনের যে বাইরের দেয়ালের ইটগুলো আনা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। কিন্তু পরে দেখা গেল, রাশিয়ান ঠিকাদাররা সেসব ইট ব্যবহার করছিল না।"
ওয়াশিংটনে সোভিয়েত দূতাবাসের নির্মাণ কাজ পরিকল্পনামাফিকই আগাচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়ায় মার্কিন দূতাবাসের নির্মাণ কাজ নিয়ে তৈরি হলো ঝামেলা। মার্কিনীরা দেখলো, রাশিয়ান ঠিকাদাররা তাদের সরবরাহ করা ইট বাদ দিয়ে স্থানীয়ভাবে তৈরি করা ইট ব্যবহার করছে। শুধু তাই না, ভবনের কংক্রীটের দেয়ালগুলোর ফাঁকে ফাঁকে তারা গোপনে আড়িপাতা যন্ত্রও বসাচ্ছে। ১৯৮৬ সালের গ্রীস্মে থমাস ড্রাইসিক যখন মস্কোতে আসলেন, তখন এই ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।
"ভবনটিকে দেখে তখন কংক্রীটের এক বিশাল স্তম্ভের মতো লাগছিল। আটতলা উঁচু একটি ভবন। কিন্তু এর ভেতরে কোন কাজই তখনো শেষ হয়নি। ভেতরে কেবল নিরেট কংক্রীটের দেয়াল। তখনো কোন লিফট বসানো হয়নি। কাজেই লিফটের জন্য রাখা জায়গাগুলো দেখাচ্ছে বিরাট গর্তের মতো। সিঁড়ির জায়গাগুলোও সাংঘাতিক বিপদজনক। আর কংক্রীটের ওপর তখনো যেহেতু সিমেন্টের আস্তর দেয়া হয়নি, তাই দেয়াল এবং মেঝে চুঁইয়ে পানি পড়ছিল। পুরো জায়গাটাকে তখন দেখাচ্ছে একটা গুহার মতো।"
এই কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল অনেক বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের একটি দল। থমাস জেন ড্রাইসিক ছিলেন এই দলের প্রধান। তাদের কাজ ছিল সোভিয়েতরা এই ভবনটিতে কত আড়িপাতা যন্ত্র বসিয়েছে, সেগুলো খুঁজে বের করা।
"খুব সহজ করে বলতে গেলে, আমাদের কাজটা ছিল, এই ভবনের ভেতরে এমন কিছু বসানো আছে কিনা, যা সেখানে থাকার কথা নয়, সেসব খুঁজে বের করা। আমরা এই কাজে এক্সরে ব্যবহার করছিলাম। এরকম কোন কিছু খুঁজে পেলে দেয়াল খুঁড়ে সেই জিনিস বের করে আনা। কিন্তু এত উঁচু একটি ভবনে এক্সরে মেশিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক বাস্তব অসুবিধা ছিল। আমাদের কাজ আগাচ্ছিল খুবই ধীর গতিতে। মস্কোর প্রচন্ড ঠান্ডা আবহাওয়ায় তাদের কাজে আরও দেরি হয়ে যাচ্ছিল। যখন তারা দেয়ালের মধ্যে কোন তার বা যন্ত্র খুঁজে পাচ্ছিলেন, সেটা আসলে কি কাজে লাগে, সেটা জানতেও তাদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছিল।"
"আমরা এমন অনেক জিনিস খুঁজে পাচ্ছিলাম, যা আসলে কি কাজ করে, তা আমরা বুঝতে পারছিলাম না। মানে আমরা জানতাম যে, এই ভবনের এরকম জায়গায় এরকম কোন কিছু থাকার কথা নয়। কিন্তু সেই জিনিসটা আসলে কী কাজে সেখানে রাখা হয়েছে তা আমরা জানতাম না। প্রযুক্তির দিক দিয়ে সেগুলো ছিল খুবই অত্যাধুনিক। কিন্তু একই সঙ্গে খুবই জটিল। আমরা কেউই জানতাম না, এসব জিনিসি কী কাজে লাগে। আমরা সবাই আসলে অন্ধকারে হাতড়াচ্ছিলাম।"
থমাস এবং তার লোকজন যখন আসলেই অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে:মস্কো আর ওয়াশিংটনের মধ্যে আড়িপাতা নিয়ে চলমান বিতর্কে এবার যেন সোভিয়েতদের পালা। তারা অভিযোগ করলো, ওয়াশিংটনে তাদের নতুন দূতাবাসে মার্কিনীরা আড়ি পাতা যন্ত্র বসিয়েছে। এরকম কয়েকটি যন্ত্র তারা প্রদর্শনও করলো।
কিন্তু মার্কিনীদের জন্য ঘটনা আরও গুরুতর হয়ে উঠলো, মস্কোতে তাদের দূতাবাসে ঘটা এক কেলেংকারিকে ঘিরে। সেখানে দায়িত্বে নিয়োজিত দুই মার্কিন মেরিন সেনা নাকি যৌনকাজের বিনিময়ে কয়েকজন রুশ মহিলা গুপ্তচরকে পুরোনো দূতাবাসের ভেতর ঢুকতে দিয়েছে।
থমাস ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসলেন। নতুন মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তায় যেসব গলদ তিনি দেখতে পেয়েছেন, সেসব তিনি বুঝিয়ে দিলেন তার উত্তরসূরিকে।কিন্তু ওয়াশিংটন তখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, তারা কি করবে। নতুন ভবনটি একেবারে ভেঙ্গে ফেলবে, নাকি অর্ধসমাপ্ত ঐ ভবনের মধ্যে আড়িপাতা যন্ত্রের ঝুঁকি মাথায় রেখে নতুন দূতাবাস সাজানোর কাজ করবে।
"এই সমস্যার আসলে কোন সোজা-সাপ্টা সমাধান নেই। আপনাকে কিছু ছাড় দিতে হবে। সবচেয়ে বড় ছাড় যেটা দিতে হলো, ভবনের যে কাঠামো ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে, সেটা বেশিরভাগ রেখে দিতে হলো। সবাই ভাবছিলেন, নইলে পুরো জায়গাটা তো বন্ধ করে দিতে হবে। তখন দূতাবাসের এত কর্মীকে কোথায় জায়গা দেয়া হবে? সেটা একটা বিরাট ঝামেলা তৈরি করবে।"
যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত মস্কোতে তাদের নতুন দূতাবাস ভবনের সবচেয়ে উপরের চারটি তলা পুরো ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি করলো। সেখানেই দূতাবাসের সবচেয়ে গোপনীয় এবং স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নিয়ে কাজ হতো। নীচের তলাগুলো বরাদ্দ করা হলো কনসুলার শাখার কাজের জন্য। এই দূতাবাস ভবন শেষ পর্যন্ত উদ্বোধন করা হয় দু হাজার সালে।
থমাস জেন ড্রাইসিক মস্কো থেকে ফিরে আসার পর বিশ্বের আরও অনেক দেশে মার্কিন দূতাবাসে কাজ করেছেন। তিনি এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়।-বিবিসি
২৫ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/টি.জে