আন্তর্জাতিক ডেস্ক: উনিশবারের ম্যাট্রিক ফেল৷ এদিকে মুখের গঠন পেঁচার মতন৷ তার উপরে আবার পিলের জ্বর ও পান্ডু রোগে কাহিল শরীর। তবে গঙ্গারাম পাত্রটি অতি ‘সৎ’৷ বংশ উচ্চ যে! বাকি এমনিতে পুরুষ-মানুষের মধ্যে একটুআধটু দোষ তো থাকেই। ও মেয়ে-মানুষের একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়। এটাই তো নারীর ধর্ম, কর্তব্য ইত্যাদি ইত্যাদি।
একটা সমাজ আর তার স্রোতে বয়ে আসা কিছু নিয়মের জঞ্জাল৷ এই জঞ্জালেই আটকে নারী। তাই আজও মেয়েদের জন্মের আগেও মরতে হয়, আর জন্ম হলেও মরতে হয়৷ কেন? মেয়ে সন্তান তো বোঝা। এবার বংশ নামক সলতেটিতে বাতি কে দেবে শুনি? দন্ডায়মান পুরষত্বের কদর জান! সেই তো ‘লিগ্যাসি’ নামক লেজটি বহন করবে। এই মেয়ে আবার বড় হবে। তার আবার বিয়ে দিতে হবে। হ্যাঁপা কম নাকি বাব্বা!
এই হ্যাঁপার চক্করেই প্রাণ গেল মিতা, কাজল, মানসী, পায়েলদের৷ কিছু চেনা, কিছু অচেনা নাম৷ কেউ ঠাঁই পেয়েছিলেন খবরের কাগজের প্রথমের পাতায়, কেউ গুরুত্ব অনুযায়ী ভিতরের পাতায়৷ ব্যস, ওইটুকুই৷ আর কেউ মনে রাখবে না যাদবপুরের ডানপিটে মেয়েটার কথা, কিংবা সোদপুরের শান্তশিষ্ট মেয়েটাকে৷ ভুলতে পারাটা যে মানুষের অভ্যাসজাত গুণ। দু-চারটি ফেসবুক পোস্ট, কিছু জ্বালাময়ী স্টেটাস -তারপর? তার আর পর নেই৷ নেই কোনও ঠিকানা৷ জীবন আবার চলতে শুরু করবে স্বাভাবিক ছন্দে।
ভারতবর্ষে নারীর স্থান সর্বদাই উপরে৷ দেবী হিসেবে পূজা পায় নারীরা৷ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সব জায়গাতেই রয়েছে কোনও না কোনও দেবীর বিশেষ কৃপা৷ কিন্তু এই দেবীই যখন মর্ত্যে জন্ম নেন সে তো তুচ্ছ মেয়ে মানুষ৷ ভোগের বস্তু মাত্র৷ যার জিন্স পড়া অপরাধ, যার রাত অন্ধকারে বাইরে বের হওয়া অপরাধ, যার ইচ্ছে থাকা অপরাধ, যার অনিচ্ছে থাকাও অপরাধ৷ যাঁকে সময়মত বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে দিতে হয়৷ এর জন্য প্রয়োজন ‘সৎ’ পাত্র।
এই ‘সৎ’ পাত্রের তালিকাটিও বেশ লম্বা৷ এই বাজারে মোটা মাইনে কিংবা সরকারি চাকুরে পাত্র পাওয়া কি সোজা কথা? পেলেই গছিয়ে দাও৷ বাকি জীবনটা নাকি সুখে কাটবে মেয়েটার৷ কিন্তু কাটল কি? কাজলও তো একরাশ স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিল শ্বশুরবাড়িতে৷ আশাভঙ্গ হয়ে বাড়িতে ফোন করে জানিয়েও ছিল মেয়েটা৷ কেউ শুনেছিলেন কী? তা আবার শোনার কী আছে? স্বামী-স্ত্রী তো একটু-আধটু ঝগড়া হয়েই থাকে৷ কাজলের তো না হয় দেখেশুনে বিয়ে হয়েছিল৷
মিতা মণ্ডল? যাদবপুরের মেধাবি ছাত্রী দারিদ্রকে হারিয়ে করেছিল পড়াশোনা৷ ভালবেসে সাধারণ এক ছেলেকে বিয়ে করেছিল৷ চোখে শুধু ছিল ভালবাসার স্বপ্ন৷ সেই স্বপ্নও তো শেষ হয়ে গেল৷ কিছুদিনের উত্তেজনা, আলোচনা-পর্যালোচনা, হা-হুতাশে স্থির জলে তরঙ্গ উঠেছিল বটে, আবার সব শান্ত।
গোটা দেশে অপরাধের হার যেখানে ৮.২ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে সেই হার ২১.৬ শতাংশ। তাও সবাই চুপ। কিন্তু আর কতদিন? চুপ। দোষই বা কার? চুপ। বাবা-মায়ের উচ্চাকাঙ্খার? মেয়ে সন্তানের বেড়ে চলা বয়সের? তার শারীরিক বৈশিষ্ট্যের? না কিছু মানুষের লোভের? নাকি সমাজের গতে বাঁধা কিছু লিখিত-অলিখিত নিয়মের? সবাই চুপ। এই নিঃশব্দের কোনও প্রতিধ্বনি নেই। সীতার সময়ও ছিল না, মিতা-কাজলের সময়েও নেই।-সংবাদ প্রতিদিন
২৫ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটি নিউজ২৪ ডটকম/সবুজ/এসএ