হাসান ফেরদৌস : আমেরিকার নাগরিক ইতিহাসের রূপকার হাওয়ার্ড জিন তাঁর মৃত্যুর আগে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, ওবামার কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা কোরো না। লোকটা নীতি নয়, আদর্শ নয়, সবার আগে নিজের স্বার্থ রক্ষা করে। অন্য সবকিছু ছাপিয়ে তিনি একজন রাজনীতিক। উদাহরণ হিসেবে হাওয়ার্ড জিন কট্টর যুদ্ধবাজ সিনেটর লিবারম্যানের উল্লেখ করেছিলেন। ২০০৬ সালে সিনেট নির্বাচনে লিবারম্যানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন শান্তিবাদী ও প্রগতিশীল নেড ল্যামন্ট। ওবামা ল্যামন্টকে সমর্থন করেননি, করেছিলেন লিবারম্যানকে। রাজনৈতিকভাবে সেটিই ছিল তাঁর জন্য অধিক লাভজনক।
এখন বারাক ওবামা তাঁর প্রেসিডেন্সির সাত বছরে এসে রাজনীতিকের খোলস ছেড়ে নেতা হয়ে উঠছেন। তাঁকে আর নতুন করে কোনো নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে না, ফলে এই শেষ দুই বছরে তিনি ইতিহাসে নিজের স্থান পোক্ত হয়, সেদিকেই মন দিয়েছেন। অন্ততপক্ষে দুটি ক্ষেত্রে তাঁর ভিন্ন অবস্থান থেকে সে কথার ইঙ্গিত মেলে। এর একটি কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন; অন্যটি ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক প্রকল্প প্রশ্নে চুক্তি।
অর্ধশতক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক চেষ্টা করে গেছে কিউবাকে তার পায়ের নিচে পিষে ফেলতে। সে জন্য ভাড়াটে সৈন্য পাঠিয়েছে, অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে, কূটনৈতিকভাবে একঘরে করতে সব কূটচাল চেলেছে। পারেনি। চেষ্টা করেছে ভাড়াটে লোক দিয়ে ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা করতে। এমনকি খাবারে বিষ মিশানোর চেষ্টা পর্যন্ত হয়েছে। কাস্ত্রো এখনো টিকে আছেন।
সেই কিউবার সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ফের জোড়া লেগেছে। আমেরিকা ইতিমধ্যে কিউবাকে সন্ত্রাসী দেশের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে এবং সে দেশের সঙ্গে মার্কিন নাগরিকদের পর্যটনের ওপর কড়াকড়ি শিথিল করেছে। ওবামা কিউবার বিরুদ্ধে আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতেও কংগ্রেসের কাছে অনুরোধ করেছেন। হিলারি ক্লিনটন, ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা, তিনিও সেই নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন।
এই পরিবর্তন রাতারাতি ঘটেনি। ফিদেল কাস্ত্রো শারীরিক কারণে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার পর তাঁর অনুজ রাউল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবার অভ্যন্তরীণ নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। কিউবার প্রতি সবচেয়ে কট্টর অবস্থান যাদের, সেই ফ্লোরিডার কিউবান-আমেরিকানদের মধ্যেও জনসংখ্যাগত পরিবর্তন এসেছে। ৬০ বছরের বেশি বয়সী কিউবান-আমেরিকানদের মধ্যে এখনো কাস্ত্রোবিরোধী অবস্থা প্রবল, কিন্তু ৩৫ বছরের কম বয়সী কিউবান-আমেরিকানদের বৃহদাংশই চায় সে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে আসুক।
আমেরিকার অধিকাংশ মানুষও এই পরিবর্তনের পক্ষে। অন্যদিকে, দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ কিউবার প্রতি ওয়াশিংটনের অবস্থানে অসন্তুষ্ট, কিউবা প্রশ্নে আমেরিকার পরিবর্তনে তারা আগ্রহী। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে ব্রাজিল। মতদ্বৈধতার কারণে এসব দেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কে নানা টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। পরিবর্তনের পক্ষে এই নাগরিক আগ্রহ ওবামার চোখ এড়িয়ে যায়নি। কোনো ‘আদর্শগত’ মতপার্থক্যের বদলে রাজনৈতিক বাস্তবতাকেই অগ্রাধিকার দিয়ে কিউবার সঙ্গে বন্ধ দরজা খুলে দিয়েছেন ওবামা।
কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন যত সহজে করা গেল, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি সম্পাদন তত সহজ ছিল না। এই চুক্তির ব্যাপারে ইরানের সঙ্গে আমেরিকা ও তার মিত্ররা সম্মত হলেও মার্কিন কংগ্রেস এখনো এর ঘোর বিরোধী। আমেরিকার এক নম্বর মিত্র ইসরায়েল এই চুক্তির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আমেরিকায় ইসরায়েল লবি লাখ লাখ ডলার খরচ করে এই চুক্তি বাতিলের পক্ষে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ওবামা তাঁর অবস্থান বদলাননি। এই চুক্তির বিকল্প ইরানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ, এই যুক্তি বগলে নিয়ে তিনি প্রায় একাই বিপক্ষ লবির মোকাবিলা করেছেন। কংগ্রেস এই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করলে তিনি তাতে ভেটো দেবেন, এ কথা আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। আর সেই ভেটো পাল্টাতে যে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন চাই, কংগ্রেসে এই চুক্তির বিপক্ষে তত ভোট নেই। ফলে এ কথা প্রায় অবধারিত যে ইরান চুক্তিটি কার্যকর হতে যাচ্ছে। সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা, ওবামার একগুঁয়ে ও অনড় অবস্থানের কারণেই আমেরিকার অধিকাংশ নাগরিক এখন তাঁদের মত পাল্টে এই চুক্তির পক্ষে।
উপসাগরীয় অঞ্চলের দু-চারটি দেশ এই চুক্তির বিপক্ষে ছিল, তারাও মিনমিনে গলায় সমর্থনের কথা জানিয়েছে। ইরানের সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক সৌদি আরবের। এই চুক্তি হলে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে, এই যুক্তিতে যেকোনো মূল্যে তার বিরোধিতা সে করে এসেছে। গত সপ্তাহে সৌদি বাদশাহ সালমান ওয়াশিংটনে এসে ওবামার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে জানিয়ে গেছেন, তিনিও চান চুক্তি হোক। (সে জন্য অবশ্য ‘উৎকোচ’ হিসেবে সৌদি আরবকে অতিরিক্ত এক বিলিয়ন ডলারের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দিতে সম্মত হয়েছে আমেরিকা)।
শুধু ইতিহাসে নিজের স্থান পোক্ত করতে নয়, একদম কঠিন-কঠোর বাস্তবতার কারণেই ওমাবা ইরান চুক্তির পক্ষে এমন স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন। ১৯৭৯ সালে ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর প্রায় ৩০ বছর কেটে গেছে, ইরানের বিপ্লবী সরকারের পতন হয়নি। সেদিক দিয়ে কিউবা ও ইরানের অবস্থায় বিস্তর মিল আছে। ৩০ বছরে যা হয়নি, আরও ৩০ বছরেও হয়তো তা হবে না।
অতএব, ওবামা যুক্তি দেখালেন, এখন সময় এসেছে ভিন্ন রণকৌশল গ্রহণের। আমেরিকার জন্য অবশ্য ইরানের সঙ্গে নমনীয় অবস্থান গ্রহণের অন্য কারণও আছে। এই মুহূর্তে সবার সামনে ১ নম্বর শত্রু ইসলামিক স্টেট বা আইসিস নামক এক দানব। একে সামলাতে না পারলে ঘর পুড়বে কেবল সিরিয়া ও ইরাকের নয়, সৌদি বাদশাহরও। শুধু ড্রোন দিয়ে বোমা ফেলে আইসিসকে ঠেকানো যাবে না, এ কথা আমেরিকা ইতিমধ্যে টের পেয়ে গেছে। কিন্তু বিদেশে নিজের সৈন্য পাঠানোর খিদে যেমন তাদের মিটেছে, তেমনি আরও একটা যুদ্ধ শুরু করার মুরোদও তার আর নেই। একমাত্র যে দেশ নিজের জনবল দিয়ে আইসিসকে ঠেকাতে পারে সে হলো ইরান। ফলে নাকে আঙুল দিয়ে ও চোখ রুমালে ঢেকে হলেও আরব দেশগুলোকে এই চুক্তি মেনে নিতে হচ্ছে। ইসরায়েল অবশ্য তার বিরোধী অবস্থান বদলাবে না, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সেটি নিজস্ব রাজনৈতিক তাস। তাঁকে উপেক্ষা করা কোনো বড় ক্ষতির কারণ হবে না, ওবামা এমন অঙ্ক করে নিয়েছেন।
কিন্তু শুধু শীতল রাজনৈতিক পাশা খেলাই ওবামাকে কিউবা ও ইরান প্রশ্নে স্রোতের বিপক্ষে যেতে উৎসাহ দিয়েছে, আমার তা মনে হয় না। একধরনের আদর্শবাদ বা আইডিয়ালিজম তাঁর ভেতর আগাগোড়াই কাজ করেছে, যার ইঙ্গিত ওবামার স্মৃতিকথা ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার-এ বিস্তর রয়েছে। রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে তাঁকে আপসের পথে আসতে হয়। রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেসকে উপেক্ষা করে তাঁর পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব হয়নি। যেমন, অভিবাসন প্রশ্নে তাঁর প্রতিশ্রুতি—পুরো অভিবাসনব্যবস্থা ঢেলে সাজানো ও অবৈধ অভিবাসীদের বৈধকরণের ব্যবস্থা—তিনি রাখতে পারেননি। অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করার প্রতিশ্রুতিও রাখা হয়নি। বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে কঠোর আইন হবে, তাঁর এই ঘোষণা শুধু কথার কথাই থেকে গেছে।
এখন প্রেসিডেন্সির শেষ পর্যায়ে এসে ওবামা ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন। শুধু কিউবা ও ইরান প্রশ্নেই নয়, অভিবাসন প্রশ্নে কংগ্রেসের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে ‘নির্বাহী আদেশের’ মাধ্যমে কাগজপত্রবিহীন অভিবাসীদের কর্মের সুযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের ঋণের বোঝা কমানোর লক্ষ্যে নতুন ‘ঋণ মওকুফ’ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। বৈশ্বিক উষ্ণতা ঠেকাতে ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ রোধে নতুন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন। কংগ্রেস তাঁর সঙ্গে নেই, তিনি চাইলেও শ্রমিকদের ঘণ্টাপ্রতি বেতন বৃদ্ধি সম্ভব নয়। সেই সত্য মেনে নিয়ে তিনি শুধু ফেডারেল কর্মচারীদের জন্য ‘ওভারটাইম’ নিশ্চিত করে নতুন নির্বাহী আদেশ দিয়েছেন। এই আদেশের আওতায় কয়েক লাখ চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী সুবিধা ভোগ করবেন। সেবাকর্মীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির আরেকটি নীতিমালাও কিছুদিন আগে গৃহীত হয়েছে।
গত সপ্তাহে নিউইয়র্ক টাইমস বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছে, প্রথম চার বছর ওবামার বিরুদ্ধে প্রগতিশীলদের প্রধান অভিযোগ ছিল তিনি আমেরিকার শেয়ারবাজারের (ওয়ালস্ট্রিট) খুব ঘনিষ্ঠ। এখন শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন, তা অধিকাংশ প্রগতিশীলকে খুশি করলেও, বলাই বাহুল্য, ওয়ালস্ট্রিট তাতে খুশি হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পায়নি।
হতে পারে ওবামার চোখ এখন ইতিহাসের দিকে। তিনি সরে যাওয়ার পর বিশ্বের মানুষ তাঁকে কীভাবে স্মরণ করবে, সেই সৌধ নির্মাণেই তিনি ব্যস্ত। কিন্তু এর পেছনে যে দীর্ঘদিনের লালিত এক স্বপ্নও কাজ করছে, তা–ও বোধ হয় অস্বীকার করা যাবে না। একসময় এই ওবামা শিকাগোর প্রান্তর্বর্তী মানুষদের সংগঠিত করার কাজে হাত দিয়েছিলেন। এই পড়ন্ত বেলায় প্রেসিডেন্ট ওবামার মধ্যে সেই ‘কমিউনিটি অর্গানাইজার’ ওবামাকেই যেন দেখা যাচ্ছে।-প্রথম আলো
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে