আব্দুল আলীম : একসময় পুরান ঢাকায় ছিল পঞ্চায়েতের দাপট। এলাকায় কোনো কাজ হবে আর পঞ্চায়েত জানবে না তা ছিল অকল্পনীয়। বিচার-সালিশ, পারিবারিক সমস্যা, সামাজিক সকল বিষয় ছিল পঞ্চায়েতের নিয়ন্ত্রণে। পাকিস্তান আমলের পঞ্চায়েতের সেই দাপট দেশ স্বাধীনের পরও কিছু কাল বজায় ছিল। তারপর আস্তে আস্তে পঞ্চায়েতের দাপট মিইয়ে যায়। শুধু নামেই এখন বহাল পঞ্চায়েত।
শুধু সম্মানটুকুর জন্য পঞ্চায়েতের সদস্য হয়ে কেউ কেউ দিন পার করছেন। তাদের কাছে আর বিচার সালিশের জন্য কেউ আসে না। সমস্যার কথাও কেউ জানান দেয় না। পুরান ঢাকার প্রতি মহল্লা পরিচালিত হতো পঞ্চায়েতের মাধ্যমে। এর প্রধানকে বলা হতো সরদার। সহযোগী হিসেবে ছিল নায়েবে সরদার। এলাকার মান্যগণ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হতো পঞ্চায়েত। এখনো সেভাবেই হচ্ছে। তবে আগের জৌলুস নেই। ক্ষমতা নেই। এখন শুধু প্রতি কোরবানি ঈদে প্রতি বাড়ি থেকে পঞ্চায়েতের নির্দিষ্ট জায়গায় মাংস পাঠিয়ে দেয়া হয়। পঞ্চায়েত সেই মাংস বণ্টন করে দেয়। মোটা দাগের কাজ বলতে শুধু এটুকুই।
৩৫ নং ওয়ার্ড পঞ্চায়েত সমাজকল্যাণ পরিষদের সহ-সভাপতি আব্দুল বারেক বলেন, পাকিস্তান আমলে পুরান ঢাকায় ছিল ২২টি পঞ্চায়েত। এগুলোর প্রধান সরদার ছিল মির্জা আব্দুল কাদের। বিচার-আচার, এলাকার সমস্যার সমাধান, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ নির্মূল, অসহায় মানুষের চিকিৎসা খরচসহ গরিবের ছেলেমেয়ে বিয়ে দেয়ার মতো সামাজিক কাজ করতো এই সব পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েতের সরদাররাও ছিল অনেক ক্ষমতাধর। মানুষও মানতো এই পঞ্চায়েতের সরদার ও নায়েবে সরদারকে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবার কাছে চলে আসে অস্ত্র। কেউ কাউকে মানতে চাইতো না। সরদার কোনো বিচার করলে গায়ের জোরে বিচার না মেনে নিজের মতো চলতো।
তিনি বলেন, এমন অবস্থায় নিজের সম্মান রক্ষার্থে সরদাররাও বিরত থাকে পঞ্চায়েতের কার্যক্রম থেকে। বিলুপ্তির পথে চলে যায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। ১৯৯৭ সালে বংশাল সাবেক ৭১ নম্বর ও বর্তমান ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন মরহুম হাজী হোসেন মোল্লা। এলাকার মানুষ গিয়ে অনুরোধ জানান পুরান ঢাকার মালিটোলার পতিতা পল্লী উচ্ছেদের। তখন কমিশনার বলেন, একার পক্ষে এ কাজ সম্ভব না। সবাই চাইলে সেটা করা যেতে পারে। তখন এলাকাবাসীর আগ্রহ ও কমিশনারের প্রচেষ্টায় পুরো পুরান ঢাকার বিলুপ্ত প্রায় পঞ্চায়েতের সরদারদের নিয়ে উচ্ছেদ করা হয় পতিতা পল্লী। এই ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয় পঞ্চায়েত। এক পর্যায়ে কমিশনার হাজী হোসেন মোল্লার হাত ধরে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে পুরান ঢাকার পঞ্চায়েত। স্বগৌরব ফিরে পায় সরদাররা। এখন পুরান ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডসহ প্রধান প্রধান এলাকায় রয়েছে পূর্ণাঙ্গ পঞ্চায়েত। এর অধীনে রয়েছে আরো কয়েকটি শাখা পঞ্চায়েত। এলাকার সমস্যাগুলো সমাধান না হলে পাঠিয়ে দেয়া হয় বড় পঞ্চায়েতের কাছে। এখানেও সমাধান না হলে পাঠানো হয় আদালতে।
মালিটোলা পঞ্চায়েতের দপ্তর সম্পাদক মো. মুরাদ হোসেন বলেন, আগের পঞ্চায়েতের ছিল সরদার ও নায়েবে সরদার। এখন পঞ্চায়েতগুলোতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি আছে। সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে পঞ্চায়েত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য সকল পদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। আমরা পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, অসহায় মানুষের সেবা, ভালোবাসা দিবস, বাবা দিবস, মা দিবসসহ বিভিন্ন দিবসের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। আমাদের ভলেন্টিয়াররা এলাকার কোথাও যদি মাদকের খবর পায় তখন সেখানে গিয়ে অ্যাকশন নেয়। আগে সরদাররা বিচার করলে পছন্দ না হলে প্রধান সরদারের কাছে যেতো। এখন পঞ্চায়েতের বিচার মনঃপূত না হলে আদালতে যায় মানুষ।
পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পঞ্চায়েত আছে। সদস্যদের বসার জন্য নির্ধারিত জায়গাও আছে। তবে নেই কোনো কমিটি। এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাকিস্তান আমলে হাজী করিম বেঁচে থাকা কালীন পঞ্চায়েতের কমিটি ছিল। স্বাধীনতার পর আর কোনো কমিটি হয়নি। এখন নির্বাচিত কাউন্সিলররাই পঞ্চায়েতের কাজ করেন। বর্তমানে এলাকার কোনো সমস্যা হলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মীর সমির আলী এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে বিচার-আচার করেন। এলাকার লোকেরা পঞ্চায়েত বলতে কমিশনার ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরই বোঝেন।
সিদ্দিক বাজার থেকে একটু ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, আলুবাজার পঞ্চায়েত কমিটির নামে রাস্তায় গেইট তৈরি করা হয়েছে। সাইনবোর্ডে লেখা এলাকার সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অসামাজিক কার্যকলাপ ও মাদকমুক্ত করতে আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা আমাদের কাম্য। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আলুবাজার হাজী ওসমান গণি রোড পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি হাজী ইয়াকুব আলী।
মোহাম্মদ আলী নামের এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, আগের পঞ্চায়েত থেকে এখনকার পঞ্চায়েত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন মানুষ ছিল কম। সবাই পঞ্চায়েত সরদারদেরকে মানতো। এখন আর আগের মতো নেই। সরদারেরও আগের মতো জৌলুস নেই। আব্দুল জলিল নামের অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, পাকিস্তান আমলে এই এলাকায় পঞ্চায়েত কমিটি ছিল। মাঝে কোনো কমিটি ছিল না। এখন দুই বছর আগে এলাকায় পঞ্চায়েত নির্বাচিত হয়েছে।
অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, শহরের মানুষ সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাদের পঞ্চায়েত করে বেড়ানোর সময় নেই। যারা রাজনীতি করে তারা পঞ্চায়েত করে। এখানে বাড়িওয়ালা, ব্যবসায়ী ও বাইরের জেলার লোক এসে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকে বেশি। তারা কেউ পঞ্চায়েতের খোঁজ রাখে না। পাকিস্তান আমলে পঞ্চায়েত দেখেছি। তখনকার সরদাররা ছিল ভালো মানুষ। তারা কাজও কারতো অনেক ভালো। এখন পঞ্চায়েত করে সরকারের নির্বাচিত কাউন্সিলররা। আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা। এরা চাঁদাবাজি-ধান্দাবাজি করে। এগুলোই এখনকার পঞ্চায়েতের কাজ।
অপর এক বাড়িওয়ালা বলেন, আগে পঞ্চায়েতে এলাকার মুরব্বি ও মানি লোকেরা বসতো। কোনো সমস্যার সমাধান সঙ্গে সঙ্গে করে দিতো। এখন পঞ্চায়েতের কাজ হয়ে গেছে কমার্শিয়াল। যার টাকা আছে তার বিচার সঙ্গে সঙ্গে হয়ে যায়। আর যার টাকা নেই তাকে বলে সময় নেই, পরে কোনো দিন বিচারের সময় দেয়।
পুরান ঢাকার সুরিটোলায় গিয়ে দেখা যায়, এই এলাকার পঞ্চায়েতের নির্বাচন আগামী সপ্তাহে। এ উপলক্ষে এলাকায় নির্বাচনী পোস্টার ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে। ৩১টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ৬৩ জন। এলাকায় বিরাজ করছে সাজ সাজ রব। প্রবীণরাও বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে চেয়ার পেতে বসে আড্ডা দিচ্ছে নির্বাচন উপলক্ষে। সুরিটোলা পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রার্থী মো. রফিক বলেন, এই পঞ্চায়েতের আগের সভাপতি ছিলেন মো. নাজিম উদ্দিন। ৩ বছর নিয়ম থাকলেও তিনি সভাপতি ছিলেন ৯ বছর। এখন নির্বাচন হবে। এতে যে প্রার্থী দাঁড়িয়েছে তার মধ্য থেকে সদস্য নির্বাচিত হবে ৩১ জন। এর মধ্যে ইন্টারনাল নির্বাচনে আবার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য পদে প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে।
তিনি বলেন, সুরিটোলা পঞ্চায়েতের আয় হয় নির্দিষ্ট ফান্ড থেকে। এলাকার হাজী ইউসুফ সাহেব মারা যাওয়ার সময় তার সম্পদ ওয়াকফ করে যান। তার নামে এলাকায় ইউসুফ মেমোরিয়াল মাদরাসা রয়েছে। এছাড়া, মসজিদের জায়গা রয়েছে যেখানে ঘর তুলে দোকান ও বাড়ি ভাড়া দেয়া হয়েছে। সেখানের আয়ের ফান্ড থেকে পঞ্চায়েতের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
প্রতি বছর পুরান ঢাকার সবগুলো পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান হয় সুরিটোলা স্কুল মাঠে। সেখানে সব এলাকার সমস্যা, সম্ভাবনা ও পঞ্চায়েত নেতাদের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়। সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, সুরিটোলা মহল্লা, সিক্কাটুলি, নাজিরাবাজার, কাহেরটোলা, মালিটোলা, বংশাল, কলতাবাজার, কসাইটুলি, বাসাবাড়ি লেনসহ বেশ কিছু পঞ্চায়েত সক্রিয় রয়েছে।
এর মধ্যে কলতাবাজার পঞ্চায়েতের সভাপতি হাজী মো. সেলিম। কসাইটুলি পঞ্চায়েতের সভাপতি হাজী মো. মাখম মিয়া, বংশাল মসজিদ পঞ্চায়েতের সভাপতি হাজী আওলাদ হোসেন, মালিটোলা পঞ্চায়েতের সভাপতি মারা যাওয়ায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাজী মিয়া হোসেন ও বাসাবাড়ি লেন পঞ্চায়েতের সভাপতি ছিলেন মৃত বাদশা মিয়া। বাদশা মিয়ার পঞ্চায়েতে এখনো নির্বাচন হয়নি। এমজমিন
১০ মার্চ ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি