সরোজ মেহেদী, ইস্তানবুল থেকে: ‘হারতে হারতে জিতে গেলেন এরদোয়ান। জিততে জিততে হেরে গেলেন পাশা’। ঠিক কোন বাক্যটি দিয়ে বুঝানো যেতে পারে দুনিয়াজোড়া দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত তুরস্কের সদ্য সমাপ্ত গণভোটকে! তীব্র লড়াইয়ের পর প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সংস্কারের লক্ষ্যে আয়োজিত এ গণভোটে এরদোয়ানের দল জিতে গেছে। তার এ জয় মানে আপাত দৃষ্টিতে তুরস্ক নামক রাষ্ট্রটি অস্থিতিশীলতার হাত থেকে রক্ষা পেল। কেউ চাক বা না চাক বিশ্বরাজনীতিতে আরও ক’বছরের জন্য শত বছর আগে সাম্রাজ্য হারানো একটি দেশ তার অবস্থান শক্তিশালী করল। কিন্তু এই গণভোট তুরস্কের সমাজে যে ক্ষতের প্রলেপ লাগিয়ে দিয়ে গেল তার কী হবে!
৫১ শতাংশ মানুষ যেখানে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন সেখানে ৪৯ শতাংশ বলেছেন ‘না’। এই পরিসংখ্যান আমাদের বলে দেয়, ‘হ্যাঁ’ জিতে গেলেও ‘না’ মোটেও দুর্বল নয়। বরং ‘না’ ওয়ালারা জিততেও পারত। তাদেরকে আসলে হারিয়ে দিয়েছে গণতন্ত্রের বেশধারী মানুষখেকো, ভ- ও প্রতারক পশ্চিমারা।
পশ্চিমা নেতাদের দরকার ছিল না তুরস্কের নিজস্ব এ গণভোট নিয়ে গায়ে পড়ে এসে কাজিয়া বাঁধানোর বা এরদোয়ান বাহিনীর হাতে ঝগড়ার রসদ তুলে দেওয়ার। একচোখা পশ্চিমা মিডিয়া গণভোটের শুরু থেকেই তুরস্ক বিরোধী অযৌক্তিক প্রোপাগান্ডায় নেমেছিল। যা তাতিয়ে দেয় কট্টর জাতীয়তাবাদী তুর্কিদের আর এর চূড়ান্ত রূপ দেয় ক্রিশ্চান বর্ণবাদী মগা রাজনীতিবিদরা। ফলে তুর্কিদের অনকের সমর্থন ঘুরে যায়।
পশ্চিমাদের এ নগ্ন অবস্থান প্রবাসী তুর্কিদের এরদোয়ানের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলে। আর এ যে স্বল্প ব্যবধানে জয় তাতে কিন্তু প্রবাসী তুর্কিরাই নিয়ামকের ভূমিকা পালন করল।
এরদোয়ান তুরস্কের ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয় শাসক। গত ১৫ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে তুর্কিদের মধ্যে বাড়তে থাকা তার জনপ্রিয়তা থেকে আমাদের এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, মুখের কথা না, টেকশই উন্নয়নই ছিল তার জনপ্রিয়তার মূল কারণ। মুখের কথায় খুব বেশিদিন চিড়া ভিজে না, ধর্মের বাণীতেও না। মানুষ খেতে, পরতে, পারতে চায়, শান্তি চায়। এরদোয়ান তুর্কিদের সে চাওয়াটা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছেন স্বীকার করলেই কেবল অন্যান্য বিষয়ে তর্ক হতে পারে।
আসলে তুরস্ক নামক দেশটি আমূল বদলে গেছে তার হাত ধরে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেওয়া তার পদক্ষেপগুলো তরস্কের মাটিতে পা দেওয়া যে কারো চোখে পড়বে। ফলে নানা মতপার্থক্য সত্ত্বেও তুর্কিরা তার উপর আস্থা রেখেছে। এর প্রতিদানও সে দিয়েছে তুর্কিদের ভাগ্যের উন্নয়নে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়ে।
তুর্কিরা গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এরদোয়ানের দলকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল। তবু এ গণভোট নিয়ে এরদোয়ান বা তার দলের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা কাজ করছিল। আর এ আশঙ্কা থেকেই তারা জোট বাঁধে বর্তমানে দেশটির সংসদে চতুর্থ বিরোধী দল এমএইচপির সাথে।
আসলে তুর্কিদের অনেকেই যারা জাতীয় নির্বাচনে এরদোয়ানকে ভোট দিয়েছিল তারাই যে সংবিধান পরিবর্তনের বেলা এরদোয়ানকে না বলবেন এমন একটি ধারণা নিয়েই মাঠে নেমেছিল এরদোয়ান শিবির। ফলে তারা নানারকম প্রস্তুতি নেয় এই গণভোটকে কেন্দ্র করে এবং শেষ পর্যন্ত সফলও হয়।
তবে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এরদোয়ান বা তার দল এ বার্তা পেল যে, তুর্কিরা তাদের ভোট দিয়ে সংসদে পাঠাতে আগ্রহী হলেও এভাবে সংবিধানে হাত চালিয়ে ক্ষমতা পরিবর্তনটা মোটেও এনজয় করছেন না। এখন দেখার পালা এরদোয়ান তুর্কিদের এ বার্তাটা কতটুকু পড়েন এবং স্বেচ্ছায় ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরেন।
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো খোঁচা দিতে গিয়ে এরদোয়ানকে সুলতান বলে ডাকে। তাকে একনায়ক বা স্বৈরতান্ত্রিক বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে দেশে দেশে অশান্তি ফেরি করে বেড়ানো এই সাদা চামড়াধারীরা এটা ভুলে যায়, টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও এরদোয়ান এমন একজন নেতা যে একটি পরিবর্তনের জন্য জনরায়ের উপর নির্ভর করে। এই চ্যালেঞ্জটা নিতে সাহস দেখায়, আবার জয়ীও হয়।
এরদোয়ানের এই সাহসকে সম্মান জানাতে না পারলে পশ্চিমাদের কপালে দুর্ভোগ আছে। একরোখা এই সুলতানের চপেটাঘাতে ওদের দাঁতের ডাক্তারের কাছে ছুটে যেতে দেখলে অবাক হব না অদূর ভবিষ্যতে।
পশ্চিমাদের হাতে রেখে বা বাম হাত দেখিয়ে এরদোয়ানের ‘নতুন তুর্কি’ ঘোড়ার যে যাত্রা শুরু হলো তা সহজে থামবে বলে মনে হয় না।
তবে এখানে একটা বড় আশংকা থেকে যায় যদি এরদোয়ান ও তার দল ক্ষত-বিক্ষত এ সমাজে মলম লাগানোর উদ্যোগ না নেন বা বেমালুম ভুলে যান ৪৯ শতাংশ মানুষের কথা। যদি এমনটা চলতে থাকে, তাহলে কে জানে হয়তো এই গভীর ক্ষতই তার ক্ষমতার মসনদ আচমকা ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়ে অবসান ঘটাবে একটি যুগের।-আমাদের সময়
সম্পাদনা: পরাগ মাঝি
১৮ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/টিটি/পিএস