আন্তর্জাতিক ডেস্ক : এ যেন এক নয়া ফরাসি বিপ্লব। গণতন্ত্রে জনগণই যে শেষ কথা তা আরেকবার প্রমাণ হলো ফ্রান্সে। জনরায়ে ভেসে গেল প্রথাগত রাজনীতি। ফরাসি জাতির নতুন প্রেসিডেন্ট কে হবেন তা জানতে ৭ই মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
তবে, প্রথম পর্বে যা হয়ে গেল তা রীতিমতো ইতিহাস। ভরাডুবি হলো শীর্ষ দুই দল কনজারভেটিভ ও সোশালিস্ট পার্টির প্রার্থীদের। বাজিমাত করলেন, রাজনীতির বাইরে থেকে আসা মধ্যপন্থি এমানুয়েল ম্যাক্রন। সামান্য ব্যবধানে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন কট্টর ডানপন্থি ম্যারিন লা পেন। অর্থাৎ ৭ই মে’র দ্বিতীয় রাউন্ড ভোটে মুখোমুখি হবেন এ দুই প্রার্থী।
মধ্যপন্থি এমানুয়েল ম্যাক্রনের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থনে ধোপেই টিকলেন না কনজার্ভেটিভ প্রার্থী ফ্রাঁসোয়া ফিলন ও সোসালিস্ট প্রার্থী বেনোয়া হ্যামন। রোববারের প্রথম দফা নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন ম্যাক্রন। তার প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ২৩.৯ ভাগ। অন্যদিকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা লা পেন পেয়েছেন শতকরা ২১.৪ ভাগ ভোট। ফলে ৬ দশকের মধ্যে রাজনীতির সব হিসাব নিকাশ এলোমেলো হয়ে গেছে।
এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এবারই প্রথম ফ্রান্সের শীর্ষ দুই দল কনজারভেটিভ ও সোসালিস্ট দলের প্রার্থীরা দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন নি। প্রথম রাউন্ডে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত ম্যাক্রন ও লা পেনের নিটকতম প্রার্থী মধ্য-ডানপন্থি ফ্রাঁসোয়া ফিলন ও কট্টর বামপন্থি জ্যাঁ লুক মেলেঞ্চন। তারা দু’জনেই পেয়েছেন শতকরা ১৯ ভাগের মতো ভোট।
শীর্ষে থাকা ম্যাক্রন শিবির উল্লাসে ফেটে পড়ছে। উচ্ছ্বসিত সমর্থকদের উদ্দেশে ম্যাক্রন নিজেকে ফ্রান্সের জন্য দেশপ্রেমিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। উদ্বেলিত ম্যাক্রন বলেন, আমি আশা করছি আগামী এক পক্ষের মধ্যে আমিই হতে যাচ্ছি আপনাদের প্রেসিডেন্ট। আমি ফ্রান্সের সব মানুষের প্রেসিডেন্ট হতে চাই। জাতীয়তাবাদীদের হুমকির মুখে আসছেন দেশপ্রেমিক প্রেসিডেন্ট।
ওদিকে তার সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের ভোটের যোগ্যতা অর্জনকারী ম্যারিন লা পেন ‘সব দেশপ্রেমিকের’ কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন ‘ফ্রান্সকে টিকিয়ে রাখার’ জন্য তিনিই মূল ব্যক্তি, তাই ভোট দেয়া উচিত তার দলকেই।
লা পেন বলেন, তারা যেখান থেকেই আসুন না কেন, তাদের ‘অরিজিন’ বা শেকড় যা-ই হোক না কেন, প্রথম দফায় তারা যাকেই ভোট দেন না কেন, আমি তাদের সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে, একই সঙ্গে পুরানো কলহ থেকে বেরিয়ে আসতে। আহ্বান জানাচ্ছি দেশের জন্য যা প্রয়োজন সেই মূল ইস্যুটি উপলব্ধি করতে।
উল্লেখ্য, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বহুল আলোচিত এমানুয়েল ম্যাক্রন সাবেক একজন ব্যাংকার। আগে যদিও ম্যাক্রন দেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তবে এবারের নির্বাচনের আগে কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নি তিনি। তাই তাকে রাজনীতিতে বহিরাগত বা আউটসাইডার হিসেবে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে যেমন হঠাৎ করে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে চমকে দিয়েছেন সারা বিশ্বকে, ফ্রান্সেও কি তেমনটা হতে যাচ্ছে- এমন জিজ্ঞাসা বিশ্লেষকদের। কিন্তু ম্যাক্রনের সঙ্গে ট্রাম্পের মিলের চেয়ে অমিলই বেশি।
একমাত্র ‘আউটসাইডার’ হওয়া ছাড়া দু’জনের কোনো মিলই নেই। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প অভিবাসন, মুসলিমবিরোধী। ফ্রান্সে এমানুয়েল অভিবাসন বিরোধী বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিরোধী নন। বরং ম্যাক্রনের প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যারিন লা পেনের সঙ্গে ট্রাম্পের মিল রয়েছে প্রচুর। লা পেনও কট্টর ডানপন্থি, এসটাবলিশমেন্ট-বিরোধী ও প্রচণ্ড ইউরোপ বিরোধী। তিনি অভিবাসন বিরোধী। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি ফ্রান্সের সীমান্ত বন্ধ করে দেবেন। ইসলামপন্থি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাই প্যারিসে সমর্থকদের এক র্যালিতে ম্যাক্রন বলেছেন, আপনাদের নামে, আমি হবো ফ্রান্সের ও ইউরোপের জন্য আশার স্থল। জাতীয়তাবাদের হুমকির বিরুদ্ধে আমি হবো দেশপ্রেমিকদের প্রেসিডেন্ট।
হেনিন-বিউমন্টে শহরে আরেক র্যালিতে লা পেন তার সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ‘ক্রোধোন্মত্ত অভিজাত’দের বিরুদ্ধে লড়াই করুন। নির্বাচনের ফল ঐতিহাসিক। ফ্রান্সকে রক্ষা করা, ঐক্যবদ্ধ করার, নিরাপদ হিসেবে গড়ে তোলার, সংস্কৃতিকে রক্ষার, সমৃদ্ধি ও স্বাধীন ফ্রান্সের জন্য বিশাল এক দায়িত্ব এসে পড়েছে এতে আমার ওপর।
ওদিকে প্রথম দফার নির্বাচনে তৃতীয় অবস্থানে আছেন রক্ষণশীল প্রার্থী ফ্রাঁসোয়া ফিলন। তিনি দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে এমানুয়েল ম্যাক্রনকে সমর্থন দেয়ার জন্য তার দল লা রিপাবলিকানকে আহ্বান জানিয়েছেন। প্যারিসে তিনি সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য রেখেছেন। সেখানে ফিলন বলেছেন, কট্টর ডানপন্থিদের বিরুদ্ধে ভোট দেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তাই আমি ভোট দেবো এমানুয়েল ম্যাক্রনকে।
সমাজতান্ত্রিক প্রার্থী বেনোয়া হ্যামোন রয়েছেন নির্বাচনে পঞ্চম স্থানে। তিনিও সমর্থন দিয়েছেন ম্যাক্রনকে। তিনি বলেছেন, আমি ফ্রন্ট ন্যাশনাল, কট্টর ডানপন্থিদের পরাজিত করার আহ্বান জানাচ্ছি। আহ্বান জানাচ্ছি এমানুয়েল ম্যাক্রনকে ভোট দেয়ার জন্য। ওদিকে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন ম্যাক্রনকে। ওদিকে নির্বাচনে চতুর্থ অবস্থানে থাকা কট্টর বামপন্থি প্রার্থী জ্যাঁ লুক মেলেনচোন পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না সরকারিভাবে ফল ঘোষণা হয়। ফলে তিনি ম্যাক্রন বা লা পেন কাউকেই সমর্থন দেন নি। এমজমিন
২৪ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি