‘গণতন্ত্রপন্থী’ নেত্রী সুচি'র দলে একজনও মুসলমান প্রার্থী নেই
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ মুসলিম। সংখ্যায় যা ৫০ লাখের বেশি হলেও দেশটিতে বরাবরই সরকারিভাবে বৌদ্ধ ধর্মকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। আসছে ৮ই নভেম্বর দেশটিতে অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের নির্বাচন। এই নির্বাচনকে মিয়ানমারের ইতিহাসে বিগত ২৫ বছরের মধ্যে প্রথম স্বচ্ছ ও বস্তুনিষ্ঠ নির্বাচন বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু আলোচিত এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী দল কোনো তালিকাতেই নেই মুসলিম প্রার্থীর নাম। মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের ব্যাপারে কেন এ বৈষম্য? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। সেই প্রতিবেদনটি প্রিয় নিউজের সহযোগীতায় পাঠকদের জন্য নিচে তুলে ধরা হলো-
মিয়ানমারের বিরোধী দল অং সান সূ চি’র এনএলডির পক্ষে আঞ্চলিক ও জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ১৫১ জন প্রার্থী। এরমধ্যে একজনও মুসলিম নেই। সেনাসমর্থিত ক্ষমতাসীন দল ইউএসডিপি’র প্রার্থী তালিকারও একই অবস্থা। এছাড়া প্রার্থী মনোনয়নের সময় বাবা-মা বিদেশি নাগরিক উল্লেখ করে বেশ কয়েকজন মুসলমানের প্রার্থিতা বাতিল করেছে স্থানীয় নির্বাচন কমিশন। তবে বাদ পড়া সেইসব প্রার্থী নিজেদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলিম প্রার্থীদের নিজ দল থেকে সরিয়ে দিয়েছেন দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী এবং এনএলডি’র প্রধান অং সান সুচি। দলের এক জ্যেষ্ঠ্য নেতা এমন তথ্য জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছে আলজাজিরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই নেতা আলজাজিরাকে জানিয়েছেন, কট্টরপন্থী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের উসকানিতে মুসলিমবিরোধী মনোভাব ক্রমাগত বাড়তে থাকার প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি শান্ত করতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সু চি।
কেন এ নিরবতা?
গণতন্ত্রের জন্য শান্তিপূর্ণ সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পান সু চি। আর তাই রোহিঙ্গাদের প্রান্তিকীকরণ এবং জাতীয় নির্বাচন থেকে মুসলিম প্রার্থীদের বাদ দেওয়ার পর গনতন্ত্রপন্থী এ নেত্রীর নিরবতাকেই সবাই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
নাম প্রকাশ না করে এনএলডির সেই নেতা আল জাজিরাকে বলেন ‘আমি মনে করি মা বা থা আন্দোলন নিয়ে খানিকটা উদ্বেগে ছিলেন সু চি। আর সে কারণে তিনি দলকে মুসলিমমুক্ত করার চেষ্টা করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘মুসলিমরা এখানে নির্যাতিত হচ্ছে। আমি মনে করি, প্রতিটি দলে সবধরনের এবং সব ধর্মেরই লোকজন থাকা প্রয়োজন। মুসলিমবিরোধী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। মা বা থা নেতাদের সহায়তা না দিয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত তাদের উপর ধরপাকড় চালানো।’
মা বা থা হল একটি অতিজাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ আন্দোলন। ধর্ম ও বর্ণের সুরক্ষাবিষয়ক অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে এটি পরিচিত হলেও সংগঠনটির নেতারা বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের আক্রমণ করে কথা বলে থাকেন।
এদিকে উইন হটেইন নামে জ্যেষ্ঠ্য এক এনএলডি সদস্য আল জাজিরাকে জানান, এ নির্বাচনে তার দল মুসলিমদের বাদ দিয়েই জয়ের সর্বোচ্চ সুযোগ নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এক্ষেত্রে দলের সম্ভাব্য মুসলিম প্রার্থীদের সম্মতি ছিল বলেও তার দাবি।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকবলিত দেশ মিয়ানমারে বরাবরই উপেক্ষিত হয়ে আসছে মুসলিম রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ইস্যু। নাগরিকত্ব না পেলেও হোয়াইট কার্ডের আওতায় ২০১০ সালের নির্বাচনেও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছিল রোহিঙ্গারা। তবে এবার তারা সে সুযোগও পাচ্ছে না। হোয়াইট কার্ডধারীরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না উল্লেখ করে চলতি বছরের শুরুর দিকে ৭ লাখ রোহিঙ্গার ভোটাধিকার নাকচ করে দেওয়া হয়। হোয়াইট কার্ড হল এক ধরনের অস্থায়ী পরিচিতিপত্র।
হটেইন বলেন, ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাদ দিয়েছে ইউএসডিপি। এক্ষেত্রে বলা চলে-ইসলাম প্রশ্নে বৌদ্ধ ভিক্ষু আর সরকার এক হয়ে গেছে। অর্থাৎ, এবারের নির্বাচন মুসলিমমুক্ত।’
‘বার্মিজ বিন লাদেনের’ হাতের ইশারা
২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে মুসলিম রোহিঙ্গা আর বৌদ্ধদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার বেশ কয়েকটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দেখেছে মিয়ানমার। ২০০৩ সালে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে সাজাপ্রাপ্ত চরমপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষু আশিন উইরাথু ২০১০ সালে মুক্তি পান। তাকে ‘বার্মিজ বিন লাদেন’ নামে ডাকা হয়ে থাকে। উইরাথুর দাবি, ২০১২ সালের দাঙ্গাটি যৌক্তিক ছিল। কারণ, মুসলিমরা রাখাইনকে একটি ইসলামী গ্রামে পরিণত করতে চাইছে।
এনএলডি দলের সেই সূত্রের বরাতে আল জাজিরা জানায়, দেশে যা কিছু ঘটছে তার নেটওয়ার্কটি পরিচালনা করছেন উইরাথু। তিনি জেলে থাকলে নির্বাচন পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু সরকার তা করেনি বলে আক্ষেপ করেছেন ওই নেতা।
অন্ধকার ছায়া:
আসন্ন নির্বাচনে ৯০টিরও বেশি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল জয়ের আশা করছে। মিয়ানমারে ১৩৫টি স্বীকৃত জনগোষ্ঠীর বসবাস। রোহিঙ্গাসহ বাকি জনগোষ্ঠীর কোনো নাগরিকত্ব নেই। দেশটিতে নির্বাচন নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো মতামত জরিপও নেই।
নির্বাচনে মা বা থার প্রভাব কী হবে তা নির্ণয় করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এনএলডি তাদের দল থেকে মুসলিম প্রার্থীদের সরিয়ে রাখলেও জাতীয়তাবাদী এ সংগঠনটি এখনও সু চির দলকে ‘ইসলামিস্টদের দল’ বলে উল্লেখ করছে।
নির্বাচনে ভোটারদের চাওয়া নিয়েও অনুসন্ধান চালিয়েছে আল জাজিরা। এ ব্যাপারে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলা হলে তারা জানায়, কাকে ভোট দেওয়া হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে তাদেরকে রীতিমত নিজের সঙ্গে লড়াই করতে হবে।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের লোকজন খুব সঙ্কটে পড়েছে। তারা জানে না কাকে ভোট দিতে হবে। এনএলডিতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে। আর সে কারণে এ দলটিকে তারা পছন্দ করতে পারছে না। তবে আবার ইউএসডিপি দলেও ভোট দেয়ার মত কোনো প্রার্থী নেই। এ দলটির গ্রহণযোগ্যতা আরও কমেছে। এনএলডি’র প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে কেবল মুসলিমরাই অসন্তুষ্ট হয়নি, অমুসলিমদের মাঝেও অসন্তোষ রয়েছে।
আর তাই বলা চলে, মিয়ানমারে জয় পরাজয়ের বিষয়টি এখন পর্যন্ত এক রকম অন্ধকারে পড়ে আছে।
৩০ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ