মঙ্গলবার, ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০৯:০৯:৪৮

উত্তর কোরিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক!

উত্তর কোরিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সার্জিক্যাল স্ট্রাইক!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : 'আপনি কি উত্তর কোরিয়ায় আক্রমণ চালাবেন?' উত্তর কোরিয়া হাইড্রোজেন বোমার সফল পরীক্ষা চালানোর দাবি করার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গতকাল এ কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাব দেন - 'আমরা দেখবো।'
কিন্তু কিম জং আনের শাসকচক্রের ওপর সত্যিই যদি আক্রমণ চালানো হয়- তা ঠিক কি ধরণের হতে পারে? উত্তর কোরিয়াকে আর কোনোভাবে সামলানোরও কি কোনো উপায় আছে?

রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের গবেষক জাস্টিন ব্রংক বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক শক্তিতে যতই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হোক না কেন, উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে আসলে আমেরিকার হাতে বিকল্পের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

এর একটি হচ্ছে : 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক' বা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল সামরিক আঘাত।
মার্কিন বিমান ও নৌবাহিনীর এ ধরণের আক্রমণ চালানোর যে ক্ষমতা আছে তা পৃথিবীর সর্বাধুনিক।
কোরিয়ার কাছে সমুদ্রে থাকা সাবমেরিনগুলো 'টোমাহক' ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ , এবং বি-টু জঙ্গীবিমান থেকে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনাগুলোতে বোমাবর্ষণ - শুনলে মনে হবে এটা বেশ আকর্ষণীয় একটা পরিকল্পনা।
আমেরিকার যে ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের পেনিট্রেটর বোমা আছে তা দিয়ে মাটির অনেক নিচে সুরক্ষিত স্থাপনারও ক্ষতিসাধন করা সম্ভব।

তবে উত্তর কোরিয়া আগেই সতর্কবার্তা পেয়ে গেলে মার্কিন পক্ষেই বিপদের ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
তাছাড়া উত্তর কোরিয়ার হাতে রুশ, চীনা এবং নিজেদের তৈরি নানাধরণের ক্ষেপণাস্ত্র ও রাডার ব্যবস্থা আছে যা গত ৫০ বছর ধরে গড়ে ওঠা - তাই তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটা যে ঠিক কি রকম, কতটুকু আধুনিক, বা কতটা প্রস্তুত - তা বের করা খুব কঠিন।

আমেরিকান কোন বিমান ভূপাতিত হলে তার ক্রুদের মুক্ত করতে গিয়ে দু:স্বপ্নের মতো পরিস্থিতি হতে পারে।
সব চেয়ে বড় কথা হলো, যদি উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক, ক্ষেপণাস্ত্র, নিয়ন্ত্রণকক্ষে মতো স্থাপনাগুলো বা নেতৃত্বের ওপর সফল হামলা চালানো যায়ও - তবু তারা অন্তত দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর হামলা চালাতে পারবে।

দুই কোরিয়ার সীমান্তে শত শত রকেট ও কামান বসানো আছে - যা দিয়ে দক্ষিল কোরিয়ার রাজধানী সোলের প্রায় এক কোটি লোকের ওপর মারাত্মক হামলা চালানো যাবে।

এগুলো সংখ্যায় এত বেশি যে মাকিন বাহিনীর পক্ষেও তা ধ্বংস করতে কয়েক দিন লাগবে - এবং তার আগেই মার্কিন-মিত্র দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপক প্রাণহানি হয়ে যাবে।

এ জন্যই দক্ষিণ কোরিয়া এরকম হামলার বিরোধী, কারণ উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়া শুধু সাধারণ কামান ও রকেট দিয়েই দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করতে পারবে।

আরেকটি বিকল্প : উত্তর কোরিয়ার ভেতরে ঢুকে পূর্ণমাত্রায় স্থল অভিযান।
কিন্তু উত্তর কোরিয়ার বিশাল সেনাবাহিনী, তাদের আর্টিলারির ক্ষমতা, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যুহ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার অনিচ্ছা - এসব কারণে এরকম অভিযানের সম্ভাবনাও খুবই কম।

তা ছাড়া এরকম অভিযান চালাতে হলে মার্কিন বাহিনীকে কয়েক মাস ধরে প্রকাশ্য প্রস্তুতি নিতে হবে, এবং পাশাপাশি উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক সক্ষমতাকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে।
এর আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো দু'পক্ষেই লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা।

১৯৫০এর দশকে কোরিয়ান যুদ্ধে চীন জড়িয়ে পড়েছিল উত্তর কোরিয়ার পক্ষ নিয়ে - যাতে তার সীমান্তের ওপারে একটি পশ্চিমা-মিত্র কোরিয়া কায়েম না হতে পারে। চীন হয়তো এখনও এরকম পরিস্থিতি দেখতে চাইবে না।
তা ছাড়া যুদ্ধের পর একটি দেশকে পুনর্গঠন করাটাও হবে এক অত্যন্ত কঠিন কাজ।
অন্য আরেকটি বিকল্প: উত্তর কোরিয়াকে সামলে রাখার চেষ্টা জোরদার করা।

এতে ঝুঁকি সবচেয়ে কম। কিন্তু এতে হয়তো কাজও হবে সবচেয়ে কম। কারণ এখন পর্যন্ত নানা ধরণের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, কিন্তু এতে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসুচি ঠেকানো যায় নি।
এ ধরণের মোতায়েন আরো বাড়াতে থাকলে উত্তর কোরিয়া একে স্থল-অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে ধরে নেবে।
রাশিয়া ও চীনও এতে আপত্তি করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অন্য ক্ষেত্রে - যেমন ইউরোপ ও পূর্ব চীন সাগরে - নানা সমস্যা তৈরি করতে চেষ্টা করবে।

যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়া, গুয়াম, এবং জাপানে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধ বিমান , যুদ্ধজাহাজ, এবং সৈন্যের সংখ্যা বাড়াতে পারে - কিন্তু এটা হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এতে উত্তেজনা ক্রমশই বাড়তে থাকবে।

পরমাণু পরীক্ষা বন্ধ করুন : উত্তর কোরিয়াকে জাতিসঙ্ঘ

উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু পরীক্ষা বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। রোববার পিয়ংইয়ং হাউড্রোজেন বোমা পরীক্ষা করার পর তিনি এ আহ্বান জানালেন।

উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচিকে অবৈধ বলেও মন্তব্য করেন গুতেরেস। বোমা পরীক্ষার ঘটনাকে তিনি আন্তর্জাতিক দায়-দায়িত্ব লঙ্ঘনের মারাত্মক দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেন। এ অবস্থায় গুতেরেস উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু পরীক্ষা বন্ধ করার জন্য পিয়ংইয়ংয়ের প্রতি আহ্বান জানান। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান ইউকিয়া আমানোও উত্তর কোরিয়ার হাউড্রোজেন বোমা পরীক্ষার বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি এ ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন।

এদিকে, উত্তর কোরিয়ার হাউড্রোজেন বোমা পরীক্ষার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে আজ (সোমবার) জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠক বসবে। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার অনুরোধে এ বৈঠক হতে যাচ্ছে।

উত্তর কোরিয়াকে ভয়াবহ জবাব দেয়া হবে : মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী

মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস বলেছেন, তার দেশের জন্য যেকোনো ধরনের হুমকি সৃষ্টি হলে সামিরকভাবে উত্তর কোরিয়াকে ভয়াবহ জবাব দেয়া হবে।

রোববার হোয়াইট হাউজের বাইরে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। এ সময় তিনি একটি লিখিত বিবৃতি পড়ে শোনান। বিবৃতিতে ম্যাটিস বলেন, “গোয়াম দ্বীপসহ মার্কিন ভূখণ্ড কিংবা আমাদের মিত্রদের প্রতি হুমকি দেখা দিলে তার ভয়াবহ জবাব দেয়া হবে। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ঐক্যবদ্ধ বক্তব্যের প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। সব সদস্য উত্তর কোরিয়ার হুমকির বিষয়ে একমত এবং তারা সবাই কোরিয় উপদ্বীপকে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করে। কারণ আমরা চাই না কোনো দেশ বিশেষ করে উত্তর কোরিয়া সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যাক।”

জেমস ম্যাটিস বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পশ্চিমা দেশগুলোর সহায়তায় উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে বেশকিছু সামরিক অপশন নিয়ে চিন্তা করছেন। এ বিষয়ে ট্রাম্প নিজেই ব্রিফ করতে আগ্রহী বলেও জানান ম্যাটিস। গতকাল উত্তর কোরিয়া হাইড্রোজেন বোমা পরীক্ষা করার পর মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এসব কথা বললেন।

হিরোশিমার চেয়ে প্রায় ৮ গুণ শক্তিশালী বোমার পরীক্ষা করেছে উ কোরিয়া

উত্তর কোরিয়া রোববার হাইড্রোজেন বোমার সফল পরীক্ষার দাবি করেছ। ভূগর্ভে এ বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, জাপানের হিরোশিমায় যে বোমা আমেরিকা ফেলেছিল এটি তার চেয়ে ৭.৮ গুণ বেশি শক্তিশালী।

উত্তর কোরিয়ার সর্বশেষ বোমার বিস্ফোরণ ক্ষমতা ১০৮ কিলোটন ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। অবশ্য, হাইড্রোজেন বোমার নিয়মিত ক্ষমতার মাত্রার মধ্যেই পড়ছে এটা । থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা কতো শক্তিশালী করা যাবে তার কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই।

পরমাণু বোমা তৈরি হয় নিউক্লিয়ার ফিশন বা নিউক্লিয়ার বিদারণের মাধ্যমে। হাইড্রোজেন বোমা তৈরি হয় একীভূতকরণ বা ফিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। অবশ্য ‘ফিশন’ ছাড়া ‘ফিউশন’ ঘটানো যায় না। ‘নিউক্লিয়ার ফিউশন’ ঘটিয়ে হাইড্রোজেন বোমা বানানোর জন্য বিপুল তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। এ তাপমাত্রা সৃষ্টি করা হয় ‘নিউক্লিয়ার ফিশন’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তাপ সৃষ্টির কাজটি করা হয় পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। এ ভাবে হাইড্রোজেন বোমায় খুবই অল্প সময়ের মধ্যে দু’টি বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

প্রথমটি ঘটে ফিশনের মাধ্যমে আর দ্বিতীয়টি ঘটানো হয় ফিউশনের মাধ্যমে। ফিউশন প্রক্রিয়ায় দুই বা তার চেয়ে বেশি হাইড্রোজেন পরমাণুকে একত্রীভূত করা হয়। এ কারণে বোমাটির নামের আগে যুক্ত হয়েছে হাইড্রোজেন ।

ফিউশনের জন্য ১০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি তাপমাত্রা প্রয়োজন পড়ে। এটি দ্রুত যোগাড় করা খুব সহজ নয়। এ জন্য হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করাও তুলনামূলক ভাবে কঠিন।

জাপানের হিরোশিমার প্রথম প্রজন্মের মার্কিন বোমার ক্ষমতা ছিল ১৩ থেকে ১৮ কিলোটন। এ বোমায় একটি মাত্র বিস্ফোরণ ব্যবস্থা ছিল। হাইড্রোজেন বোমার মতো দ্বিতীয় প্রজন্মের বোমায় রয়েছে দুটি বিস্ফোরণ ব্যবস্থা। এতে ধ্বংস ক্ষমতা শত শত গুণ বেড়ে যায়। হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণে লাখ লাখ ডিগ্রি তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়।
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে