মঙ্গলবার, ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০৯:২৩:২০

ভারত-পাকিস্তান : কে এগিয়ে কে পিছিয়ে

ভারত-পাকিস্তান : কে এগিয়ে কে পিছিয়ে

মূল ইংরেজি : রিয়াজ মোহাম্মদ খান | ভাষান্তর : গোলাপ মুনীর: এখন পাকিস্তান ও ভারতের জনগণ তাদের নিজ নিজ দেশের ৭০তম স্বাধীনতাবাষির্কী পালন করছে। এই সময়ে তাদের উচিত অন্তবীক্ষণের তথা আত্মবীক্ষণের। এই দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়টি ব্যাপকভাবে দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ ও স্বভাবকটুতার এক ইতিহাস। তাদের স্বাধীনতা অর্জন সময়ের দুঃখজনক পরিস্থিতি আজো স্মৃতিকে তাড়িয়ে বেড়ায়, ঠিক যেমনি প্যারাডক্সিকেলি (আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যবিবর্জিত নয়) এদের মধ্যে রয়েছে অংশগ্রহণমূলক সংস্কৃতির অনুরণন এবং বহু শতাব্দীর অভিন্ন অভিজ্ঞতা। দেশ দু’টির মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও তুলনামূলক স্বস্তিবোধের এবং গুরুত্বপূর্ণ লেনদেনের একটা সময়ও ছিল, যেমন পানিবণ্টনের চুক্তিগুলো। প্রশ্ন হচ্ছে: এরা কি আবার স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে?

ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো ভারতে চাকরি করিনি এবং আমার ভারতীয় সমকক্ষদের সাথে কথাবার্তা সীমিত ছিল ফেব্রুয়ারি ২০০৫ থেকে এপ্রিল ২০০৮ পর্যন্ত বিস্তৃত মোটামুটি উদ্বেগহীন একটি সময় পরিধিতে। আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল, কিন্তু আমরা কূটনৈতিক সৌজন্য বজায় রেখে তা মোকাবেলা করতে পেরেছিলাম। আমরা সক্ষম হয়েছিলাম ২০০৫ সালের এপ্রিলের দিল্লি ঘোষণার ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছতে। এতে নিশ্চিত ঘোষণা ছিল, দেশ দু’টি শান্তিপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিকারী কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সমর্থন করবে না। আমরা ২০০৬ সালের জুলাইয়ের মুম্বাই ট্রেনে বোমা-হামলার ঘটনাকে শান্তিপ্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে দিইনি। তা সত্ত্বেও, ২০০৮ সালের নভেম্বরের মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী হামলা সংলাপকে নিশ্চল করে দেয়। নিশ্চিতভাবে, ভারতের সাথে সংশ্লিষ্ট আমার অনেক সহকর্মী কিছুটা কম সুখকর পরিস্থিতিতে ছিলেন।

তর্কসাপেক্ষে, এই দুই দেশের দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে কাশ্মির সমস্যার বিষয়টি। এর প্রভাব পড়েছে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ধারণা ও নীতিতে। বিষয়টি দেশ দু’টির স্বাধীনতার সূচনার সময় থেকেই পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহকে শোচনীয় করে তোলে। এর পরও এই বিরোধ অপরিহার্যভাবে রাজনৈতিক, অতএব সমাধানযোগ্য। ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের অবস্থানের ভিত্তি হচ্ছে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবগুলো, যেগুলো সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না এমন আদর্শগত ভিত্তি নেই। বিরোধটি মেটানোর ব্যাপারে নেয়া বেশ কিছু দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগের মধ্যে সর্বশেষ ও টেকসই আলোচনা চলে ব্যাক চ্যানেলের মাধ্যমে (২০০৫-০৬) প্রেসিডেন্ট মোশাররফ ও প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মধ্যে। গুরুত্বপূর্ণ হলো, উভয়পক্ষ দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা এই বিরোধ মেটাতে চেষ্টা চালিয়েছে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তিতে পৌঁছার মাধ্যমে। উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও অর্জিত হয়েছিল। সর্বদলীয় হুরিয়াত কনফারেন্সের নেতাদের সাথে পরামর্শও করা হয়। শুধু সৈয়দ আলী গিলানি একদম শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যান করেন।

ধারণাটি ছিল সরল : একটি সমঝোতার পথ বের করা। আর এই সমঝোতা অপরিহার্যভাবে দেশ দু’টির স্বার্থ সংরক্ষণ করবে এবং নিশ্চিত করবে কাশ্মিরিদের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা, যাতে এই উপ-অঞ্চলে কাশ্মিরিরা নিজেরাই নিজেদের প্রভু হতে পারে। যদি ২০০৭ সালে জুডিশিয়াল সঙ্কট বাধা হয়ে না দাঁড়াত এবং উদ্যোগটি স্বাভাবিকভাবে আরো কয়টি বছর চলতে পারতÑ তবে এটি হতে পারত নাটকের চূড়ান্ত অঙ্ক। সিয়াচিন ও স্যার ক্রিক নিয়ে সামান্য বিরোধের কথা বাদ দিলে অনেক সুষ্ঠু প্রস্তাব ছিল আলোচনার টেবিলে। এর আগে ১৯৮৭ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজবি গান্ধী নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছিলেন সিয়াচিন থেকে প্রত্যাহার করতে। ভারতীয় সামরিক নেতারা এখন তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। হিমালয় ও কারাকোরামের ভঙ্গুর পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য এই বড় আকারের হিমবাহ রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যার ওপর এখন চাপ পড়ছে অব্যাহত সামরিক কর্মকাণ্ডের প্রভাবে ও জ্বালানি পোড়ানোর ফলে।

আমার মনে আছে, সংলাপে অংশ নেয়া আমার ভারতীয় এক বন্ধুকে বলেছিলাম, এর (সিয়াচিনের) নিচে স্বর্ণের পাহাড় রয়েছে বলেও যদি আমরা জানি, এর পরও বলব যৌথ তদারকির মাধ্যমে আরো বেশি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে এই হিমবাহের বরফ সংরক্ষণ করা যৌক্তিক দাবি রাখে। একইভাবে, স্যার ক্রিকের অগভীর জলরাশিকে (মোটামুটি হিসেবে ৭৫ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত) পরিণত করা যেতে পারে একটি যৌথ উদ্যোগের পুণ্যস্থান বা ন্যাচার পার্কে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে দ্বন্দ্বের এসব নাট্যশালাকে পরিণত করা যেতে পারে সহযোগিতার নানা ক্ষেত্রে। এসবই এখন শুনতে মনে হয়, এগুলো প্রত্যাশার ভাবনা।

দুই দেশের সম্পর্ক এখন একদম নি¤œপর্যায়ে নেমে এসেছে। যখন বেশ কিছু মিলিট্যান্ট পাটানকোট ও উরি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালায়, মোদি সরকার পাকিস্তানের সাথে সব ধরনের সংলাপ বন্ধ করে দেয়। অভিযোগ তোলা হয়, এই হামলা চলেছে পাকিস্তানের অনুপ্রেরণায়। নয়া দিল্লি সুবিধাজনক অবস্থান থেকে এড়িয়ে চলে ইটপাটকেল নিক্ষেপকারী কাশ্মিরিদের ওপর ভারতের পরিচালিত নির্মম দমন-পীড়নের বিষয়টি, যার সূচনা হয়ছিল গত বছরের তিন প্রজন্মের কাশ্মির উপত্যকার ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রত্যাখ্যানের সূত্রে।

হিন্দু জাতীয়তাবাদী ঢেউয়ে উদ্দীপ্ত ও পুনর্জাগরিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি ও বিজেপির কট্টরপন্থীরা ভাবছেন, এরা পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে এবং এরা চায় শুধু তাদের শর্তাধীনের একটি সংলাপ। পাকিস্তানও কিছুটা পিছুটান দিতে পারে। কারণ, এর সামনে রয়েছে নিজস্ব কিছু চালেঞ্জ। এগুলো পাকিস্তানকে মোকাবেলা করতে হবে। পাকিস্তান অপেক্ষা করতে পারে সেই সময় পর্যন্ত, যতক্ষণ নয়া দিল্লি যৌক্তিক একটা অবস্থানে ফিরে না আসে। তা সত্ত্বেও, ঊভয় রাজধানীর নেতাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, এরা উত্তেজনা জিইয়ে রাখছে পারমাণবিক বিপদ মাথায় নিয়ে। আর এই হুমকিটা শুধু বেড়েই চলছে।

দক্ষিণ এশিয়া পাল্টে যায় ১৯৯৭ সালের মে মাসের দিকে, যখন ভারত ও পকিস্তান হয়ে ওঠে পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ। দেশ দু’টি এখন বাধ্য দায়িত্বশীল সংযত আচরণ প্রদর্শনে, যা সবার আগে নির্ভর করে পরিমিত পারস্পরিক আস্থা অর্জনের ওপর। প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ ও সংলাপ অপরিহার্য, যাতে এই সঙ্কট কোনো ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে না আনে। সংলাপ উন্মুক্ত করে সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র; এর অভাবে ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। শান্তির স্বার্থে বিভিন্ন পর্যায়ের যোগাযোগের বাইরে মাঝেমধ্যে উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ খুবই মূলবান। নিউক্লিয়ার এক্সচেঞ্জকে রাখতে হবে চিন্তাভাবনার বাইরে।

উভয় পক্ষের অবশ্যকর্তব্য হচ্ছে ডেঞ্জারাস ডকট্রিন বাতিল করা। যেমন, কোল্ড স্টার্ট (পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের ক্ষেত্রে ব্যবহারের ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সূচিত একটি মিলিটারি ডকট্রিন, এর কথা হচ্ছে সম্মিলিত ব্যাটল গ্রুপ হিসেবে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সব শাখা মিলে একযোগে আগ্রাসী হামলা চালানো) এবং পাকিস্তানের ক্ষুদ্র পারমাণবিক অস্ত্রের সাহায্যে সমালোচনার দ্রুত জবাব দেয়া। কোনো সন্ত্রাসী হামলা ঘটলে দ্রুত বিজয়ের লক্ষ্যে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার সুস্থতার পরিচায়ক নয়। ট্র্যাজেকটরির সব পয়েন্টেই কূটনীতি ও সঙ্কটব্যবস্থাপনাকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। উভয় দেশ সচেতনতার সাথে অবলম্বন করেছে ‘মিনিমাম ক্রেডিবল ডিটারেন্সের ধারণাকে এবং এটিকে এদের প্রতিরক্ষা নীতির জন্য প্রয়োজনীয় হিসেবে নিয়েছে। ঘুরেফিরে আসা উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে মিডিয়া হচ্ছে একটি ওয়াইল্ড কার্ড। মিডিয়ার উচিত আগুন ছড়িয়ে দেয়ার কাজ থেকে বিরত থাকা। বাড়াবাড়ি করাটাই বিপজ্জনক।

চীনের উত্থান ও রাশিয়ার আবারো শক্তিধর হয়ে ওঠার মাধ্যমে বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য এখন নিরন্তর পরিবর্তনের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য চ্যালেঞ্জের মুখে। ভারত প্রত্যাশা করছে বৃহৎশক্তি হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার। এটি হতে পারে। কিন্তু এসব টেকটনিক পরিবর্তন অপরিহার্যভাবে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্য শিক্ষণীয় উদাহরণ উপস্থাপন করে অন্যান্য অঞ্চলের জন্য। পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে পাকিস্তান বৈশ্বিক ও আঞ্চলিকভাবে ধরে রেখেছে গুরুত্ব, শক্তিমত্তা, সম্পর্ক ও বিকল্প।

দেশ দু’টি বন্দী হয়ে আছে অনির্দিষ্টকালের এক শত্রুতার মাঝে। আমরা দ্বিজাতিতত্ত্বকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না কেন, তা বিবেচনার বাইরে রেখে আমি সেসব ব্যক্তির একজন, যারা এটি মেনে নিতে পারে না যে, পাকিস্তান ভারতের নিছক একটি এন্টিথিসিস তথা সরাসরি বিপরীত বস্তু। পাকিস্তানের রয়েছে এর স্বতন্ত্র চেতনা, অনন্য এক ইতিহাস এবং এর ইতিবাচক প্রত্যাশা। ভারত ও পাকিস্তানের ৭০তম স্বাধীনতাবার্ষিকীর দিকে তাকিয়ে আমি দেখি দু’টি পবিত্র নদী: ‘টু স্যাকরেড রিভার্স’, যেগুলো একই উৎসের ভাগীদার এবং বয়ে চলেছে বিপরীত দিকে। এর পরেও এরা একই মহাদেশের এবং প্রবাহিত হবে চিরদিন।
লেখক : পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও গ্রন্থাকার। সূত্র : Dawn.com
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে