শনিবার, ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১০:৫২:৩২

ভারতীয় মুসলমানদের নিয়ে এক বক্তব্যেই তোলপাড়

ভারতীয় মুসলমানদের নিয়ে এক বক্তব্যেই তোলপাড়

মাসুম মুরাদাবাদী: মুসলমানদের মধ্যে বাড়তে থাকা নিরাপত্তাহীনতা ও শঙ্কার অনুভূতিকে শব্দের পোশাক পরিয়ে বিদায়ী উপরাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ হামিদ আনসারি তার বিদায়ী ভাষণে যা কিছু বলেছেন, তা ব্যথিত হৃদয়ের আওয়াজ বলে মনে হচ্ছে। তিনি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণনের বাক্য পুনরাবৃত্তি করে বলেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিচয় এ বিষয় দিয়ে হয় যে, সে তার সংখ্যালঘুদের কেমন নিরাপত্তা দিতে পারে। এর এক দিন আগে হামিদ আনসারি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মুসলমানদের মধ্যে অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি বিদ্যমান। তিনি গণপিটুনিতে মুসলমান হত্যা এবং ঘরওয়াপসির মতো বিষয়গুলোকে ভারতের মর্যাদার পরিপন্থী বলে আখ্যায়িত করেন।

বর্তমানে ভারতের মুসলমানদের জীবনপরিধিকে সঙ্কীর্ণ করে দিতে ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো এমন সব কাজ করে যাচ্ছে, যার অনুমতি রাষ্ট্রের সংবিধান তো দেয়ই না, মানবতাও দেয় না। ক্ষমতার নেশায় উন্মত্ত সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরা পুরো ভারতে মারাত্মক সন্ত্রাস ছড়িয়ে রেখেছে। ক্ষমতার সব দিক দখল করার উৎসব যেভাবে পালন করা হচ্ছে, তা দেখে অনুমান করা যায়- এখন ভারত ‘সঙ্ঘ পরিবারের’ জায়গিরে পরিণত হয়েছে। এখানে শ্বাস নেয়ার জন্যও তাদের অনুমতি প্রয়োজন হবে। অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি এ কথাতেই আঁচ করা যায়Ñ আনসারির ভাষণে সঙ্ঘ পরিবার হইচই শুরু করে দিয়েছে। এমন কোনো মন্দ কথা নেই, যা তার বিরুদ্ধে সংবাদপত্র ও টিভিতে বলা হয়নি। মুহাম্মদ হামিদ আনসারি এতটুকুই তো বলেছেন, ভারতে মুসলমানদের মধ্যে অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি রয়েছে। ভারতের শক্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী দফতরের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কারো ভারতীয় হওয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা মারাত্মক হয়রানিমূলক কাজ। তিনি বলেন, বারবার দেশপ্রেম প্রমাণ করা আবশ্যক হওয়া উচিত নয়। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কি এ চিন্তার সাথে একমত যে, মুসলমান আশঙ্কাগ্রস্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে যেভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, তার ফলে তারা নিজেদের নিরাপত্তাহীন ভাবছে? তখন জবাব দিলেন, এ অনুমান সঠিক। আমি দেশের বিভিন্ন স্তর থেকে এ কথাগুলো শুনছি এবং এ কথাই ব্যাঙ্গালুরুতেও শুনেছি। উত্তর ভারতে মানুষের মাধ্যে অস্থিরতা বেশি এবং নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে শিকড় গজাচ্ছে।

হামিদ আনসারির এ বক্তব্যে এমন কিছু রয়েছে যে, পুরো সঙ্ঘ পরিবার ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা এটা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। ওরা এতটাই অস্থির হয়েছে, তাদের মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে শুরু করে। হামিদ আনসারির বক্তব্য প্রত্যাহার ও তাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য আপাদমস্তক শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ থেকে বিদায় নেয়ার সময় যাকে মনোরম পরিবেশে বিদায় দেয়া উচিত ছিল, উল্টো তার বিরুদ্ধে সীমাহীন লজ্জার বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে। জ্ঞানান্ধদের কাছে এতটুকু শিষ্টাচারবোধ ছিল না, যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ১০ বছর থাকলেন, যা হোক তার তো কিছুটা হলেও মর্যাদা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও নবনির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট ভেঙ্কাইয়া নাইডু থেকে নিয়ে বিজেপির নিশানধারী নেতারা পর্যন্ত হামিদ আনসারিকে যে ভাষায় সম্বোধন করেছেন, তা সঙ্ঘ পরিবারের আসল রূপ প্রদর্শনের জন্য দরকারের চেয়েও বেশি।

দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, হামিদ আনসারির বক্তব্যের পর কিছু ‘আপন’ লোকও তোপের মুখ তার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। এ অবুঝ ও আবেগপ্রবণ লোকদের জানা নেই যে, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যখন থেকে ভারতে গণপিটুনি ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন থেকে হামিদ আনসারী অব্যাহতভাবে নিষ্ঠার সাথে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে এসেছেন। তিনি কয়েকবার মুসলমানদের সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন।

আপনাদের মনে থাকার কথা, দুই বছর আগে অল ইন্ডিয়া মুসলিম মাজলিসে মুশায়ারাতের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যখন তারা মুসলমানদের পিছিয়ে পড়া এবং জাতীয় উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্ত না করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তখন এ নিয়েও সঙ্ঘ পরিবার এমনই মাতম শুরু করেছিল। ৩১ আগস্ট ২০১৫ নয়াদিল্লির ইন্ডিয়া ইসলামিক কালচারাল সেন্টারে মুশাওয়ারাতের সুবর্ণজয়ন্তী সভায় বক্তৃতাকালে আনসারি বলেছিলেন, ভারতের মুসলমানদের মৌলিক সমস্যাগুলো চারটি বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে প্রথমটি, স্বকীয়তা ও নিরাপত্তা। দ্বিতীয়, শিক্ষা এবং নিজেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী বানানো। তৃতীয়, সরকারি কর্মকাণ্ডে সমান অংশিদারী এবং চতুর্থ, আইন প্রণয়নে ইনসাফভিত্তিক অংশগ্রহণ। তিনি এ বিষয়গুলোকে নাগরিক অধিকারের অংশ বলে অভিহিত করেছেন।

সার্চ কমিটির সুপারিশমালা বাস্তবায়ন সম্পর্কে কুণ্ডু কমিটির ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে হামিদ আনসারি বলেছিলেন, ওই কমিটি এ ফলাফল দেখিয়েছে যে, শুরু যদিও হয়েছে, তথাপি সার্চ কমিটির বাস্তবায়নে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কুণ্ডু কমিটির রিপোর্টে ওই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার জন্য বিশেষ সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছিল। ওই সময়ও হামিদ আনসারি মুসলিম সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন এবং তাদের নিরাপত্তাবোধকে শক্ত ভিত দেয়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন।

অল ইন্ডিয়া মুসলিম মাজলিসে মুশাওয়ারাত মুসলিম দলগুলোর একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন। এর সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা এ কথার প্রতি ইঙ্গিত দেয়, হামিদ আনসারি দেশ ও জাতির ব্যথায় সমভাবে অংশীদার। অনুরূপ, তিনি বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল মুসান্নিফীন আজমগড়ের শতবর্ষ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করে নিজের বিদ্যানুরাগের প্রমাণ উপস্থাপন করেছিলেন। এ কথা সবাই জানে, মুহাম্মদ হামিদ আনসারি তার জীবনের বেশির ভাগ সময় রাষ্ট্রদূত হিসেবে অতিবাহিত করেছেন। অবসরের পর তিনি আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর এবং এরপর জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান হন।

এরপর তাকে ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট বানানো হয়। তিনি প্রতিটি পদেই যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ, যা সাধারণত একটি প্রদর্শনীমূলক পদ মনে করা হয়, তিনি ওখানে থেকেও নিজের অস্তিত্বের পরিপূর্ণ জানান দিয়েছেন। রাজ্যসভার চেয়ারম্যান হিসেবে পার্লামেন্টে নিজের কর্ম ও অন্য ব্যস্ততার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, তিনি অনুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী। এত কিছু ভালো গুণ থাকা সত্ত্বেও সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা তাকে সব সময় সমালোচনার নিশানা বানিয়েছে। কেননা ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে একজন মুসলমানের উপস্থিতি তাদের মনঃপূত নয়। যোগব্যায়াম বা ইয়োগা দিবসের অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ না করার ব্যাপারেও বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছিল, অথচ প্রোটোকলের বিবেচনায় ওখানে তার উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল না। তা ছাড়া তিনি আমন্ত্রিতও ছিলেন না। এমনকি প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে সালাম প্রদানের সময় এমন এক ইস্যুতে সমালোচনার তীর ছোড়া হয়েছে, যা মূলত তার দায়িত্বে ছিল না।

দুঃখজনক কথা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার বিদায়ী অনুষ্ঠানে বিদ্রƒপাত্মক ভঙ্গিতে কথা বললেন। তিনি বলেন, এখন আপনি নিজের আসল ভাবনা অনুপাতে কাজ করতে স্বাধীন। অনুরূপ নবাগত ভাইস প্রেসিডেন্ট ভেঙ্কাইয়া নাইডু বলেছেন, কিছু মানুষ রাজনৈতিক ফায়দা নিতে সংখ্যালঘু বিষয় টেনে নিয়ে আসে। এ ছাড়া শিবসেনা ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতারা তাদের নোংরা মানসিকতা অনুপাতে তাকে নিশানা বানায়। এমনকি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুরেন্দ্র কুমার জৈন তাকে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। সঙ্ঘ পরিবারের এসব ছোট-বড় নেতার কথায় বেশ অনুমান করা যাচ্ছে, ভারতে অসহনীয় অবস্থা তার চূড়ান্ত সীমায় গিয়ে পৌঁছে। শুধু সাধারণ মুসলমানই নয়, বরং ওইসব ব্যক্তি যারা তাদের পুরো জীবন দেশের সেবায় অতিবাহিত করেছেন, তারাও খারাপ লোকদের হাত থেকে নিরাপদ নন। মুসলমানদের মাঝে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা ও ভয় যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ এ কথাটিও সূর্যের আলোর মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলবে। দাদরিতে মুহাম্মদ আখলাকের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে হরিয়ানার জুনাইদ ও ঝাড়খণ্ডের গোলাম আনসারি পর্যন্ত অসংখ্য মুসলমানকে সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরা হিংস্রভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে এবং সরকারি সংস্থাগুলো অপরাধীদের দণ্ড দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ভারতে অসহনীয় পরিবেশের ঠিকানা জানার জন্য কোনো বিশেষ তদন্তের প্রয়োজন নেই। কেননা প্রতিটি দরজা ও দেয়ালে এ কথা লেখা রয়েছে।

মুসলমানদের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি বিষয় মিটিয়ে দেয়া, ইতিহাস মুছে দেয়া এবং মুসলমানদের কীর্তি নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রয়াস এখন তুঙ্গে। এমনকি দেশের একটি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ইনফরমেশন কমিশন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চেয়েছেÑ তাজমহল কি কবর, নাকি মন্দির? যদি ভারতে এমনই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহই তার রক্ষাকর্তা।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দু টাইমস ১৩ আগস্ট ২০১৭ থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে