আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত দুই সপ্তাহে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে অভিযানে হাজারেরও বেশি সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমান নিহত হয়েছে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও রাখাইন বৌদ্ধদের উদ্যোগে জাতিগত নিধন ও গণহত্যার ফলে রাখাইন তথা পুরো মিয়ানমারই এখন রোহিঙ্গাশূন্য হতে চলেছে।
দুই সপ্তাহ ধরে আশ্রয়প্রার্থী মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী ঢলের পর রাখাইন রাজ্যে আর কতজন রোহিঙ্গা অবশিষ্ট আছে, তা নিয়েই বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা সাংবাদিকদের বলেছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার পর তারা শুধু প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। সেখানে আর কেউই অবশিষ্ট নেই। হয় তারা বাংলাদেশের পথে আছে কিংবা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে।
মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ যে বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে তাতে সেখানে হত্যাযজ্ঞে নিহতের সংখ্যা ১০ হাজারও ছাড়িয়ে গিয়ে থাকতে পারে।
পরিস্থিতি দেখাতে গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমার সরকার যে সাংবাদিকদের রাখাইন রাজ্যের পাঁচটি গ্রামে নিয়ে গিয়েছিল তাঁরাও সেখানে কোনো রোহিঙ্গার অস্তিত্ব দেখেননি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাখাইন রাজ্যে ঠিক কত সংখ্যক রোহিঙ্গা ছিল সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য মেলে না। কয়েক বছর আগেও এ সংখ্যা ১১ থেকে ১৩ লাখ বলে ধারণা করা হতো। তবে সাম্প্রতিক সহিংসতার সময় জাতিসংঘে সেখানে তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিল।
মিয়ানমার সরকার দুই সপ্তাহ আগে ৭৮৭ জন রোহিঙ্গাকে হত্যার কথা স্বীকার করে তাদের ‘জঙ্গি’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। বিশ্বজুড়ে সমালোচনার মধ্যে গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমার নতুন করে স্বীকার করেছে, গত ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের অন্তত ছয় হাজার ৮০১টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রায় ৩০ জন বেসামরিক নাগরিকও হত্যার শিকার হয়েছে। নিহতদের মধ্যে সাতজন রোহিঙ্গা মুসলমান, সাতজন হিন্দু এবং ১৬ জন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
ইউরোপে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সংগঠন ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিলের (ইআরসি) মুখপাত্র অনিতা চুগ দাবি করেছেন, ২৫ আগস্ট থেকে তিন দিনেই দুই হাজার থেকে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী হত্যা করেছে। এর মধ্যে গত ২৭ আগস্ট রাখাইনের রাথেডং শহরের সগপাড়া এলাকায় ৯০০ থেকে এক হাজার জনকে হত্যা করা হয়। ওই এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ থেকে মাত্র একটি ছেলে বেঁচে গেছে।
ইআরসির মুখপাত্র বলেছেন, ‘২০১২ সাল ও গত বছরের অক্টোবর মাসে রাখাইন রাজ্যে হত্যাযজ্ঞে নিহতের সংখ্যাও এবারের হত্যাযজ্ঞ ছাড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতি কখনো এতটা খারাপ ছিল না। রাখাইনে আমরা গণহত্যার শিকার হচ্ছি। ’
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত দুই সপ্তাহে দুই লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ সংখ্যা তিন লাখ ছাড়াবে বলে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। এর আগে গত বছরের ৯ অক্টোবর থেকে এ বছরের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত এসেছে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। তারও আগে থেকে এ দেশে অবস্থান করছে মিয়ানমারের প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা। এর বাইরে এ দেশে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত আছে ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা। এ হিসাব অনুযায়ীই বর্তমানে মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বলেছেন, খুব সম্ভবত মিয়ানমার সরকার নিহতের সংখ্যা অনেক কম করে বলছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ও ভয়াবহ বিষয় হলো মিয়ানমার সরকার সেখানে বাইরের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। ফলে বাস্তব পরিস্থিতি জানার সুযোগ হচ্ছে না।
সংস্থাটির মিয়ানমারে মানবাধিকারবিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার (বিশেষ দূত) ইয়াংহি লি গতকাল শুক্রবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও সহিংসতার মাত্রা থেকে তাঁরা ধারণা করছেন এক হাজার বা তারও বেশি রোহিঙ্গা মুসলমান এরই মধ্যে নিহত হয়েছে। তাঁর মতে, উভয় পক্ষেই হতাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও রোহিঙ্গারাই ব্যাপকভাবে এর শিকার হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) গতকাল এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গাদের গ্রামে মিয়ানমার বাহিনীর অগ্নিসংযোগ, নির্বিচার গুলিবর্ষণকে জাতিগত নিধন প্রচেষ্টা হিসেবে অভিহিত করেছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্নিয়াং নিজেই গণমাধ্যম কর্মীদের বলেছেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘অসমাপ্ত কাজ’টি তারা এবার সম্পন্ন করছেন।
এইচআরডাব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সেনাবাহিনীর হামলার ও গ্রাম ধ্বংসের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছে। সশস্ত্র কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযানেও বেসামরিক লোকজনের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
মিয়ানমারের ভেতর রোহিঙ্গাদের জন্য ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়তে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব দেশের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছে।
এদিকে, মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানকে পরিকল্পিত ‘গণহত্যা’ ও ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে অভিযোগ উঠলেও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেশটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। উদ্বেগ জানিয়ে এবং পরিস্থিতি সামলানোর আহ্বান জানিয়েই দায় সারছে বিভিন্ন দেশ। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশন আগামী মঙ্গলবার শুরু হচ্ছে। এ অধিবেশনে সাধারণ বিতর্ক পর্বে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি উঠবে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। তবে মিয়ানমার তার বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ ঠেকাতে চীন, রাশিয়ার মতো নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। এদিকে ভারতের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদল গত বৃহস্পতিবার ইন্দোনেশিয়া বিশ্ব সংসদীয় ফোরামের বৈঠকে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে গৃহীত প্রস্তাব সমর্থন করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে।
জানা গেছে, ইরাক ও আফগানিস্তানের পর এরই মধ্যে বিশ্বে সর্বোচ্চসংখ্যক শরণার্থীর জোগানদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে মিয়ানমার। শুধু রাখাইন রাজ্যই নয়, মিয়ানমারের আরো অনেক রাজ্যেই জাতিগত সমস্যা রয়েছে। তবে অং সান সু চির সরকার রোহিঙ্গা ছাড়া অন্য সবার সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয়েছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা সবচেয়ে বেশি আশ্রয় পেয়েছে বাংলাদেশে। এ ছাড়া পাকিস্তানে দুই লাখ, থাইল্যান্ডে এক লাখ, মালয়েশিয়ায় ৪০ হাজার, ভারতে ৪০ হাজার, যুক্তরাষ্ট্রে ১২ হাজার, ইন্দোনেশিয়ায় ১১ হাজারেরও মতো রোহিঙ্গা আছে বলে জানা যায়।
তবে বর্তমানে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নতুন করে আর মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ধারণের ক্ষমতা নেই বাংলাদেশের। তাই মিয়ানমারেই রোহিঙ্গাদের নিরাপদে বাঁচার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস