কাজল ঘোষ, চীন থেকে : ভাবুন তো হাঁটছেন হঠাৎ মেঘেরা আপনাকে ছুঁয়ে দিয়েছে। মিষ্টি রোদের ফাঁকে তুলতুলে মেঘ পাহাড়ে লুকিয়েছে। চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আকাশের সঙ্গে মিলে রং বদলাচ্ছে। মুন লেকের বাতাসে মন উদাসী হাওয়ায় রঙিন স্বপ্নে পাল তুলেছে।
দিন গিয়ে রাত এসেছে। তাতে কে বাদ সেধেছে? চারপাশে আলো ঝলমল করছে। ত্বালির এনসিয়েন্ট ক্যাপিটাল সিটি (পুরনো রাজধানী) যেন আপনাকেই খুঁজছে। এ যেন দিনের চেয়েও রঙিন। দোকানিরা নানা পণ্যের পসরা নিয়ে বসে আছে। দিন-রাতের বালাই নেই।
স্থানীয়রা তাই বলে ত্বালি শহর কখনো ঘুমায় না। এক পাশে ইরহাই লেক। অন্য পাশে মাইলের পর মাইল ফুলের বাগান। চাংশান পাহাড়ের ১৯টি চূড়া। ১৮টি সুদৃশ্য ঝরনা। মাঝেমধ্যেই ত্বালি ক্লাউড (Dali cloud)। প্রকৃতির এক অন্যরকম দ্যোতনা। যেখানে আকাশ-পাহাড়-মেঘের মিতালী।
তিনদিন ত্বালিতে থাকবো এটা শিডিউলে লেখাই ছিল। কিন্তু এই তিনদিন যে কিভাবে চলে গেল তা টেরই পাইনি। বাস যখন ত্বালি ডাউন টাউনে প্রবেশ করে তখন যে ধরনের আহা, দারুণ, দ্যাখ দ্যাখ শুনছিলাম ঠিক ফেরার দিন উল্টোটাই হলো। এক মন খারাপ করা বহর নিয়ে ফেরা। কুনমিং থেকে তিন শ’ কিলোমিটার দূরের এই শহরটি যেতে আমাদের সময় লেগেছিল পাঁচ ঘণ্টা।
মাঝখানে তিনবার চায়ের বিরতি আর একবার দুপুরের ভোজ। মাঝেমধ্যেই গাইড ই আমাদের বলছিল ত্বালি শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা। কুবলাই খাঁ আর তার দৌহিত্র চেঙ্গিস খাঁরা রাজত্ব করেছে ত্বালিতেই। একে বলা হয় সিটি অব রোমান্স। একথা শুনতেই আমাদের অনেকের মধ্যে হাসির ঝিলিক। মনে হয় তারা হারিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই যাচ্ছে ত্বালিতে। জোরে করতালি।পেছন থেকে দুই একজনের শিস। কিন্তু কোনো কিছুই ই-কে থামাতে পারেনি।
কুবলাই খাঁর সময় থেকেই ত্বালিতে মুসলিম বা হুইয়ে সমপ্রদায়ের বাস। এখানকার মোট জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই বাই সমপ্রদায়ের। এরাই মূলত এখন ত্বালির সংস্কৃতি জীবনাচারণে বেশিরভাগ অংশের নেতৃত্বে। এরা চীনের একমাত্র স্বায়ত্তশাসিত এলাকা ত্বালির বাসিন্দা হিসেবে গৌরববোধ করে। ত্বালি কিংডমের প্রতিষ্ঠাতাও এই বাই জনগোষ্ঠীর লোকেরাই।
এ অঞ্চলে একসময় বৌদ্ধ রাজারা শাসন করেছে। সে সময় বিকাশ ঘটেছে বৌদ্ধদের। চীনে বৌদ্ধধর্ম চার ভাগে বিভক্ত। তারমধ্যে ত্বালিতে বাস করে যারা তাদের বলা হয় আচালি বুদ্ধ মতের অনুসারী। তাওয়িজম, বুদ্ধিজম আর কনফুশিয়াসিজম একসঙ্গেই ত্বালির বিভিন্ন স্থানে বাস করছে। কোনো কোনো টেম্পলে একসঙ্গে এই তিন মতবাদের প্রধানদের প্রতিকৃতি ঠাঁই পেয়েছে। আর ত্বালির অন্যতম দর্শনীয় স্থান থ্রি প্যাগোডা তো মিং শাসনামলে বৌদ্ধ রাজাদের যুগের সাক্ষ্য হিসেবে আজও অমর হয়ে আছে।
গাইডের মুগ্ধ করা সব তথ্যের ফাঁকে ফাঁকে তাকিয়ে দেখছিলাম ইউনানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। পাঁচ ঘণ্টার এই পথ পুরোটাই পাহাড়ি। এক পাহাড় থেকে যেন আরেক পাহাড়ে চলছে আমাদের বাস। আর হঠাৎ হঠাৎ বাস ঢুকে পড়ছে বিশাল বিশাল টানেলে। এমনও হয়েছে পনের বিশ মিনিট আমাদের বাস পাহাড়ের নিচে তৈরি টানেল দিয়ে ছুটে চলছে। এই সব পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে বাস করে চীনের এথনিক জনগোষ্ঠী। যারা আজকের উন্নত চীন দেখছি।
তার উল্টো চিত্র এসব এলাকায়। এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দারাই আধুনিক জীবনের সঙ্গে নিজেদের এখনো সম্পৃক্ত করতে পারেনি। পাহাড়ের অনেক এলাকা এখনো এতটাই দুর্গম যে, সেখানে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যবস্থা নেই। নেই হাট-বাজারও। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমরা যে সিল্ক রোডের কথা বইপত্রে পড়েছি। যা ত্বালি শহরের ওপর দিয়ে চলে গেছে। একসময় এশিয়ার সকল ব্যবসায়ী চা আর সিল্ক নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে পাড়ি দিতো মাইলের পর মাইল। ত্বালি ছিল তাদের বিশ্রাম স্থান।
ত্বালির এনসিয়েন্ট সিটিতে হতো বিকিকিনি আশেপাশের ভিয়েতনাম, তিব্বত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার হয়ে এই পথ বিস্তৃত ছিল ভারত পর্যন্ত। এই সিল্ক রোড দুইভাগে বিভক্ত ছিল। একটি সাউথ সিল্ক রোড। অন্যটি নর্থ সিল্ক রোড। যার মাধ্যমে নতুনভাবে আবারো এশিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে এই পথ নিয়ে চিন্তা করছে চীন সরকার। ই একসময় থেমে যায়। কারণ, আর কথার দরকার নেই। এখন শুধুই পরখ করে দেখার পালা। ত্বালি সত্যি সত্যিই বর্ণনার চেয়ে সুন্দর।
মেঘেদের দলবল আমাদের দলবলের মাথা খারাপ করে দিয়েছে কিছু সময়ের মধ্যেই। মুন লেকের পারে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা যাই এনসিয়েন্ট টাউনে। চীনা ভাষায় ত্বালি এনসিয়েন্ট সিটিকে বলা হয় ইউচেং সিটি। এই সুরক্ষিত শহরটি ছিল দক্ষিণ-পশ্চিম চীন থেকে সিল্করুটের সঙ্গে মূল সংযোগস্থল। একসময় এখানে ছিল সরকারি দফতর আর সেনা ছাউনি। এর সাড়ে সাত মিটার অর্থাৎ প্রায় চব্বিশ ফুট উঁচু এবং প্রায় উনিশ ফুট চওড়া। দেয়ালের মোট পরিধি ছয় কিলোমিটার।
এখানে ঢোকার জন্য চারদিকে রয়েছে চারটি বিশাল গেট। অবিশ্বাস্য চওড়া দেয়ালের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গের মতো ঢোকার পথ আর তার ওপর চীনা স্থাপত্যরীতির দুস্তর ছাদওয়ালা গেট টাওয়ার। এক সময় দেয়ালের ওপরও ছিল চারটি এরকম গেট টাওয়ার। বর্তমানে বহু পরিবর্তনে বদলে অনেক কিছু। সবশেষ ১৯৮২ সালে মেরামত করা হয় উত্তর এবং দক্ষিণ দিকের গেট ও টাওয়ার দু’টি।
ভেতরে ঢুকলেই চমৎকার বর্ণিল ফুলের বাগান আর তার আশপাশে টুরিস্টদের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ফুলের মতোই সেজেগুজে অপেক্ষামাণ বাই তরুণীরা। দেয়ালঘেরা প্রাচীন শহরটির ভেতরে গাড়ি চলাচলের নিয়ম নেই। ফলে পর্যটকরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারে। আমরাও বিকালের কনে দেখা আলোয় দল বেঁধে বেরিয়ে ফিরি এন হোটেলে। মনের ভেতরে অনেক না দেখা আর অনেক না জানা উঁকি দিচ্ছিল।
কে আটকে রাখে আমাদের সেই পথ থেকে ফেরাতে। তৃষ্ণার্থ মনের ক্ষুধা মেটাতে আমরা দলে দলে হারিয়ে যাই পুরনো সেই রাজধানীর আলোকিত রজনীতে। আজ আমাদের ঘরে ফেরার কোনো তাড়া নেই। মধ্যরাতেও যেন ফকফকা দিন। ত্বালির ইরং স্ট্রিট (ফরেন স্ট্রিট) চব্বিশ ঘণ্টাই প্রস্তুত থাকে অতিথিদের জন্য।
খুব মনে পড়ে মিশকাত ভাই, টিপু ভাই, মাথাও ভাই, আজীম, নিউটন, তিথি, জবাসহ দলছুট আরো অনেকেই মধ্যরাতে ফুটপাথে বসে একশ’ আরএমবি দিয়ে দুই কেজি ওজনের জ্যান্ত রুই মাছ ঝাল মসলা দিয়ে রান্না করে চপস্টিকের কাঠি দিয়ে রসনায় ডুবে যেতে। কখনওবা বিশালাকৃতির বেগুন দিয়ে কাবাব করে খেতে।
যে নামে তোমায় ডাকি : Wind, Flower, Snow, Moon & Dali| বাতাস, ফুল, তুষার এবং চাঁদ এ নিয়ে ত্বালি যেন সমার্থক। এই সেই স্থান যেখানে বিখ্যাত সেই চলচ্চিত্র ঋরাব এড়ষফবহ ঋষড়বিৎ নির্মিত হয়েছে। এটা এক অদ্ভুত রহস্যময় জায়গা যা নিয়ে মিং জিন তার মার্শাল আর্ট ছবি ঞরড়হষড়হম ইধনষব নির্মাণ করেন। পৃথিবী বিখ্যাত লোকগান Trickling brooklet এর জন্ম শহর এটিই।
এটি চীনের বাই জাতিগোষ্ঠীর একমাত্র স্বায়ত্তশাসিত শহর। বাই জাতিগোষ্ঠীর বাইরে অন্তত আরো এক ডজন নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আধার ত্বালি। এই শহর বিশ্বকে বিস্মিত করে তার ইতিহাস দিয়ে। বিচিত্র সংস্কৃতি, অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং অনন্য নৃ-তাত্ত্বিক রীতিনীতির মাধ্যমে। চীনের সাংস্কৃতিক শহর হিসেবে ত্বালি খ্যাত। চীনের সম্ভ্রান্ত রুচিশীল পর্যটকদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে বরাবরই ত্বালি।
কুনমিং থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরের এই শহরে সড়ক ও আকাশ উভয় পথেই যাওয়া যায়। এই শহরের গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই ওঠানামা করে। এর তাপমাত্রা এমনই রোমান্টিক যেখানে গ্রীষ্মে কখনোও গরম নেই আবার শীতেও তীব্র ঠাণ্ডা নেই। ত্বালিতে রয়েছে ১৩০টি দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কেন্দ্র। মিং এবং চিং ডায়নেস্টির স্থাপত্য শৈলীর ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে ৭০০ বছরের পুরনো এই শহর।
চাংশান পর্বতমালার হাজারো রকম ফুল আর চায়ের উষ্ণতা আপনাকে স্বাগত জানাবে। বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা ত্বালিতে এসে আয়েশি জীবনযাপন করে। আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো, পায়ে হেঁটে নগরীর শত বছরের নিদর্শন তাদের মশগুল রাখে দিন-রাত। ত্বালি বিখ্যাত আরো বেশকিছু কারণেও। শুধু প্রকৃতি নয়, হাতে তৈরি এখানকার মেয়েদের বাটিক, কারুশিল্প, ক্যাকটাস, ক্যামেলিয়া আকর্ষণ করে পর্যটকদের।
শহরের মাঝখানে ইরহাই হ্রদ দেখতে অনেকটাই মানুষের কানের মতো। এর জল হাওয়ায় ভ্রমণ আপনাকে এক অন্যরকম তৃপ্তি ও সতেজতা এনে দেবে। ইরহাইতে রয়েছে মাছ ধরার ব্যবস্থাও। ত্বালি হচ্ছে ঝরনার স্বর্গরাজ্য। দেশ-বিদেশের পর্যটকরা এই ঝরনার জলে গা ভিজিয়ে সিক্ত হন। ঝরনা, ফুল, গাছ এই তিন সম্পদে সমৃদ্ধ চাংশান পর্বতমালাকে বলা হয় প্রাকৃতিক জাদুঘর। ত্বালি বিখ্যাত তার জলরঙের মার্বেল পাথরের জন্য। এটা দুনিয়াজুড়ে খ্যাত ত্বালি শি বা ত্বালি স্টোন বলে। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি